মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৮৭
ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বিদুরের আগমন ও সদুপদেশ দানের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বিদুরের আগমন ও সদুপদেশ দানের কাহিনি
যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে ফিরে এসে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা কোরে সঞ্জয় চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে ডেকে এনে বললেন, পাণ্ডবদের কাছ থেকে ফিরে এসে সঞ্জয় আমাকে ভর্ৎসনা করেছে, আগামীকাল সে যুধিষ্ঠিরের কথা জানাবে। আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি, আমার ঘুম আসছে না, মনে শান্তি নেই, সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। বিদুর, তুমি আমাকে সৎপরামর্শ দাও।
বিদুর বললেন, মহারাজ, যুধিষ্ঠির সমস্ত প্রকার রাজোচিত গুণের অধিকারী এবং ত্রিভুবনের অধীশ্বর হওয়ার যোগ্য। তিনি আপনার অনুগত থাকা সত্ত্বেও দুর্যোধনাদির অন্যায় কাজকে আপনি সমর্থন করেছিলেন বলে তাঁরা নির্বাসনে গিয়েছিলেন। আপনি ধর্মজ্ঞ হলেও অন্ধ, সেজন্য রাজ্যলাভের যোগ্য নন। দুর্যোধন, শকুনি, কর্ণ ও দুঃশাসনকে অন্যায়ভাবে প্রশ্রয় দিয়ে রাজ্যলাভ করিয়ে আপনি কি করে যশস্বী হতে পারেন? আপনি পাণ্ডবগণকে তাদের পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দিন, তাতে আপনি ও আপনার পুত্রেরা সুখী হবেন, আপনার অখ্যাতি দূর হবে। যত কাল মানুষের সুনাম বজায় থাকে হয় তত কালই সে স্বর্গসুখ ভোগ করে। আপনি পাণ্ডুপুত্রদের সঙ্গে ধর্মসঙ্গত ব্যবহার করুন, তাতে আপনি ইহলোকে সুনাম এবং মৃত্যুর পরে স্বর্গ লাভ করবেন। একটি প্রাচীন কাহিনি বলছি শুনুন -
“কেশিনী নামে এক অতুলনীয়া রূপবতী কন্যা ছিলেন। তার স্বয়ংবরে প্রহ্লাদের পুত্র বিরোচন উপস্থিত হোলে কেশিনী তাকে প্রশ্ন করলেন, ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ না দৈত্য শ্রেষ্ঠ? বিরোচন বললেন, প্রজাপতি কশ্যপের বংশধর দৈত্যরাই শ্রেষ্ঠ, সর্বলোক আমাদেরই অধীন। কেশিনী বললেন, কাল সুধন্বা এখানে আসবেন, তখন তোমাদের দুজনকেই দেখবো। পরদিন সুধন্বা এলে কেশিনী তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বসবার জন্য আসন দিলেন। বিরোচন বললেন, সুধন্বা, আমার এই স্বর্ণনির্মিত আসনে বসুন। সুধন্বা বললেন, তোমার আসন আমি স্পর্শ করলাম কিন্তু তোমার সঙ্গে বসব না। তোমার পিতা আমার আসনের নীচে বসেন। বিরোচন বললেন, সোনা, গরু, ঘোড়া প্রভৃতি অসুরদের যে সম্পদ আছে সে সমস্তই আমি পণ রাখছি, যিনি অভিজ্ঞ তিনিই বলবেন আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ। সুধন্বা বললেন, তোমার সম্পদ তোমারই থাকুক, জীবন পণ রাখা হোক।
দুজনে প্রহ্লাদের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ বললেন, তোমরা ইতিপূর্বে কখনও একসঙ্গে চলতে না, এখন কি তোমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে? বিরোচন বললেন, পিতা, বন্ধুত্ব হয়নি, আমরা জীবন পণ রেখে তর্কের মীমাংসার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সুধন্বার সংবর্ধনার জন্য প্রহ্লাদ পরিচারকদের বহুবিধ মহার্ঘ বস্তু আনতে বললে, সুধন্বা বললেন, ওসব থাকুক, আপনি আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিন - ব্রাহ্মণ হিসাবে আমি শ্রেষ্ঠ, না বিরোচন শ্রেষ্ঠ? প্রহ্লাদ বললেন, সুধন্বার পিতা অঙ্গিরা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সুধন্বার মা বিরোচনের মায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। বিরোচন, তুমি পরাজিত হয়েছ, তোমার প্রাণ এখন সুধন্বার অধীন। সুধন্বা, আমার অনুরোধে তুমি বিরোচনকে প্রাণদান করো। সুধম্বা বললেন, দৈত্যরাজ, আপনি ধর্মানুসারে সত্য কথা বলেছেন, পুত্রের প্রাণরক্ষার জন্য মিথ্যা বলেন নি, সেজন্য বিরোচনকে মুক্তি দিলাম। ইনি কুমারী কেশিনীর সামনে আমার পা ধূয়ে দিন।”
কাহিনি শেষ করে বিদুর বললেন, মহারাজ, পরের রাজ্য লাভের জন্য মিথ্যা বলে আপনি আপনার পুত্র, মিত্র ও সহযোগি সহ বিনষ্ট হবেন না। পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করুন, পাণ্ডবরা যেমন সত্যপালন করেছেন, দুর্যোধনকেও সেইরূপ সত্যরক্ষা করতে বলুন, তিনি পূর্বে যে পাপ করেছেন আপনি তার প্রায়শ্চিত্ত করুন। বিদুর আরও অনেক উপদেশ দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তুমি যা বললে সবই সত্য, পাণ্ডবদের সঙ্গে আমি ন্যায়সংগত ব্যবহার করতে চাই, কিন্তু দুর্যোধন কাছে এলেই আমার বুদ্ধির পরিবর্তন হয়। বিদুর, তোমার কথা অতি বিচিত্র, যদি আরও কিছু বলবার থাকে তো বলো। বিদুর বললেন, আমি শূদ্রযোনিতে জন্মেছি, অধিক কিছু বলতে সাহস করি না। জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ সনৎকুমার আপনার সকল সংশয় দূর করবেন।
বিদুর স্মরণ করলে সনৎকুমার তখনই এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদুর বললেন, ধৃতরাষ্ট্র সংশয়াপন্ন হয়েছেন, আপনি এমন উপদেশ দিন যাতে এঁর সকল সংশয় দূর হয়। বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে সনৎকুমার ধর্ম ও মোক্ষ বিষয়ে বহু উপদেশ দিলেন।
______________
(ক্রমশ)