Story of Mahabharat Part 81 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 81

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 81

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৮১

দুর্যোধনাদির মৎস্যরাজ্যের উত্তর দিক আক্রমণ ও অর্জুনের কাছে পরাজয়ের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

দুর্যোধনাদির মত্স্যদেশের উত্তর দিক আক্রমণ ও অর্জুনের কাছে পরাজয়ের কাহিনি

ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা যখন মত্স্যদেশের দক্ষিণ দিকে বিরাট রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যান, সেই সময়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে দুর্যোধন মৎস্যদেশের উত্তর দিকে উপস্থিত হলেন এবং গোপালকদের তাড়িয়ে দিয়ে ষাট হাজার গরু হরণ করলে, গোপদের প্রধান দ্রুতবেগে  রাজধানীতে পৌঁছে বিরাটের পুত্র উত্তরকে সেই সংবাদ দিয়ে বললো আপনি শীঘ্র গিয়ে গরুগুলিকে উদ্ধার করুন।

উত্তর বললেন, যদি দক্ষ কোনও সারথি পাই তবে এখনই ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধে যেতে পারি। তুমি শীঘ্র একজন সারথি নিয়ে এসো। উপযুক্ত রথচালক পেলে আমি দুর্যোধন, ভীষ্ম, কর্ণ, কৃপ, দ্রোণ প্রভৃতিকে হারিয়ে দিয়ে গরু উদ্ধার করে আনব। আমি সেখানে ছিলাম না বলেই কৌরবরা গরু হরণ করেছে। কৌরবরা আজ আমার বিক্রম দেখে ভাববে, স্বয়ং অর্জুন আমাদের আক্রমণ করলেন নাকি?

দ্রৌপদী উত্তরের মুখে এই কথা এবং অর্জুনের নাম উল্লেখ করা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি বললেন, রাজপুত্র, বৃহন্নলা আগে অর্জুনের সারথি ও শিষ্য ছিলেন, তিনি অস্ত্রবিদ্যায় অর্জুনের চেয়ে কম নন। আপনার ছোট বোন উত্তরা যদি বলেন তবে বৃহন্নলা নিশ্চয় আপনার সারথি হবেন। ভাইয়ের অনুরোধে উত্তরা তখনই নৃত্যশালায় গিয়ে অর্জুনকে সকল ঘটনা জানিয়ে বললেন, বৃহন্নলা তুমি আমার ভাইয়ের সারথি হয়ে যাও, যদি আমার কথা না শোন তবে আমি জীবন ত্যাগ করব। অর্জুন উত্তরের কাছে গিয়ে বললেন, যুদ্ধস্থানে সারথি হতে পারি এমন শক্তি কি আমার আছে? আমি কেবল নাচ, গান, বাজনা জানি। উত্তর বললেন, তুমি গায়ক, বাদক, নর্তক যাই হও, শীঘ্র আমার রথে উঠে চালনা করো।

অর্জুন তখন উত্তরার সামনে উলটো করে কবচ পরতে গেলেন, তা দেখে কুমারীরা হেসে উঠল। তখন উত্তর স্বয়ং তাঁকে মহামূল্য কবচ পরিয়ে দিলেন। যাত্রাকালে উত্তরা ও তার সখীরা বললেন, বৃহন্নলা, তুমি ভীষ্ম ও দ্রোণাদিকে জয় করে আমাদের পুতুলের জন্য বিচিত্র কোমল বস্ত্র এনো। অর্জুন বললেন, উত্তর যদি জয়ী হন তবে নিশ্চয় সুন্দর সুন্দর বস্ত্র আনব।

অর্জুন বায়ুবেগে রথ চালালেন। কিছুদূর গিয়ে শ্মশানের নিকটে এসে উত্তর দেখতে পেলেন, বিশাল কৌরবসৈন্য ব্যূহ রচনা করে রয়েছে, সাগরের ঢেউয়ের মতো তাদের গর্জনের শব্দ হচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর বললেন, আমি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো না, ওদের মধ্যে অনেক মহাবীর আছেন, যাঁরা দেবগণেরও অজেয়। আমার পিতা সমস্ত সৈন্য নিয়ে গেছেন সুশর্মার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য, আমার কাছে সৈন্য নেই, আমি বালক, যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। বৃহন্নলা, তুমি ফিরে চলো।

অর্জুন বললেন, রাজপুত্র, তুমি যাত্রা করবার সময় সবার কাছে অনেক গর্ব করেছিলে, এখন পিছিয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি যদি চুরি হয়ে গরু উদ্ধার না কোরে ফিরে যাও তবে সকলেই উপহাস করবে। সৈরিন্ধ্রী আমার প্রশংসা করেছেন, আমি কৃতকার্য না হয়ে ফিরব না। উত্তর বললেন, কৌরবরা সংখ্যায় অনেক, তারা আমাদের ধন হরণ করুক, সবাই আমাকে উপহাস করুক, কিন্তু আমি যুদ্ধ করতে পারব না। এই বলে উত্তর রথ লাফিয়ে রথ থেকে নামলেন এবং ধনুর্বাণ ত্যাগ করে বেগে পালাতে লাগলেন। অর্জুন তাকে ধরবার জন্য পিছনে ছুটলেন।

রক্তবর্ণ কাপড় পরে লম্বা বেণী দুলিয়ে অর্জুনকে ছুটতে দেখে কৌরবদের কয়েকজন সৈনিক হাসতে লাগল। কৌরবগণ বললেন, ছাইচাপা আগুনের মতো এই লোকটি কে? একে দেখতে কতকটা পুরুষের আর কতকটা স্ত্রীর মতো। এর মাথা, ঘাড়, বাহু ও গতি অর্জুনের তুল্য। বোধ হয় বিরাটের পুত্র আমাদের দেখে ভয়ে পালাচ্ছে আর অর্জুন তাকে ধরতে যাচ্ছেন।

অর্জুন কিছুদূর গিয়ে উত্তরের চুল ধরলেন। উত্তর কাতর হয়ে বললেন, বৃহন্নলা, তুমি আমার কথা শোনো, রথ ফেরাও, বেঁচে থাকলেই মানুষের মঙ্গল হয়। আমি তোমাকে অনেক ধন দৌলত দেবো, তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। অর্জুন উত্তরকে রথের কাছে টেনে এনে বললেন, তুমি যদি না পারো তবে আমিই যুদ্ধ করব, তুমি আমার সারথি হও। আতঙ্কিত উত্তর নিতান্ত অনিচ্ছায় রথে উঠলেন এবং অর্জুনের নির্দেশে শমীবৃক্ষের দিকে রথ নিয়ে চললেন।

কৌরবপক্ষের বীরগণকে দ্রোণাচার্য বললেন, নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বাতাসে বালি উড়ছে, আকাশ ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে, অস্ত্রসকল কোষ থেকে পড়ে যাচ্ছে। তোমরা সাবধানে হয়ে আত্মরক্ষা করো, গরুগুলিকে রক্ষা করো, মহাধনুর্ধর অর্জুনই নপুংসক বেশে আসছেন তাতে সন্দেহ নেই।

কর্ণ বললেন, আপনি সর্বদা অর্জুনের প্রশংসা আর আমাদের নিন্দা করেন, অর্জুনের শক্তি আমার বা দুর্যোধনের ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। দুর্যোধন বললেন, ওই লোক যদি অর্জুন হয় তবে আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে, আমরা ওদের চিনতে পেরেছি। সেজন্য পাণ্ডবদের আবার বারো বছর বনে যেতে হবে। আর যদি অন্য কেউ হয়, তবে তীক্ষ্ম বাণে ওকে হত্যা করবো।

শমীবৃক্ষের কাছে এসে অর্জুন উত্তরকে বললেন, তুমি শীঘ্র এই গাছে উঠে পাণ্ডবদের ধনু, বাণ, পতাকা ও কবচ নামিয়ে আনো। তোমার ধনু আমার উপযুক্ত নয়, শত্রুদের বিনষ্ট করতেও পারবে না। উত্তর বললেন, শুনেছি এই গাছে একটা মৃতদেহ বাঁধা আছে, আমি রাজপুত্র হয়ে কি কোরে তা ছোঁব? অর্জুন বললেন, ভয় পেয়ো না, ওখানে মৃতদেহ নেই, যা আছে তা ধনু প্রভৃতি অস্ত্র। তোমাকে দিয়ে আমি নিচু কাজ করাবো কেন? অর্জুনের আদেশ অনুসারে উত্তর শমীবৃক্ষ থেকে অস্ত্রসমূহ নামিয়ে এনে বাঁধন খুলে ফেললেন এবং দীপ্তিমান অস্ত্রগুলি দেখে ভয়ে রোমাঞ্চিত হলেন। তার প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন বললেন, এই ধনু অর্জুনের আর এরই নাম গাণ্ডীব, খাণ্ডব বন দহনের সময় বরুণের নিকট অর্জুন এই ধনু পেয়েছিলেন। এই ধনু ভীমের, ইন্দ্রগোপচিহ্নিত এই ধনু যুধিষ্ঠিরের, সোনার সূর্য চিহ্নিত এই ধনু নকুলের, স্বর্ণময় পতঙ্গচিহ্নিত এই ধনু সহদেবের। তাদের বাণ তূণীর খড়্গ প্রভৃতিও এই সঙ্গে আছে।

উত্তর বললেন, মহাত্মা পাণ্ডবগণের অস্ত্রসকল এখানে রয়েছে, কিন্তু তারা কোথায় ? দ্রৌপদীই বা কোথায় ? অর্জুন বললেন, আমিই অর্জুন, সভাসদ কঙ্ক যুধিষ্ঠির, পাচক বল্লভ ভীম, ঘোড়াশালা আর গোশালার অধ্যক্ষ নকুল আর সহদেব। সৈরিন্ধ্রীই দ্রৌপদী, যার জন্য কীচক মরেছে। উত্তর বললেন, আমি অর্জুনের দশটি নাম শুনেছি, যদি বলতে পারেন তবে আপনার সব কথা বিশ্বাস করব। অর্জুন বললেন, আমার দশ নাম বলছি শোন - আমি সমস্ত দেশ জয় করে ধন সংগ্রহ করি সেজন্য আমি ধনঞ্জয়, যুদ্ধে শত্রুদের জয় না করে ফিরি না সেজন্য আমি বিজয়, আমার রথে শ্বেতবর্ণের ঘোড়া থাকে সেজন্য আমি শ্বেতবাহন, উত্তর ও পূর্ব ফল্গুনী নক্ষত্রে আমার জন্ম সেজন্য আমি ফাল্গুনী, দানবদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইন্দ্র আমাকে উজ্জ্বল কিরীট দিয়েছিলেন সেজন্য আমি কিরীটী, যুদ্ধকালে বীভৎস কাজ করি না সেজন্য আমার নাম বীভৎসু, বাম ও ডান দুই হাতেই আমি অস্ত্র চালনা করতে পারি সেজন্য নাম সব্যসাচী, সমগ্র পৃথিবীতে আমার অমলিন খ্যাতি এজন্য নাম অর্জুন, আমি শত্রুবিজয়ী এজন্য নাম জিষ্ণু এবং সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ বালক ছিলাম তাই পিতা আমার কৃষ্ণ নাম রেখেছিলেন।

অর্জুনকে অভিবাদন করে উত্তর বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনার দর্শন পেয়েছি, আমি না জেনে যা বলেছি তা ক্ষমা করুন। আমার ভয় দূর হয়েছে, আপনি রথে উঠুন, যেদিকে বলবেন সেদিকে নিয়ে যাবো। কিন্তু কোন্ কাজের জন্য আপনি নপুংসক হয়েছেন? অর্জুন বললেন, যুধিষ্ঠিরের আদেশে আমি এক বছর ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করছি, আমি নপুংসক নই। এখন আমার ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। অর্জুন তার বাহু থেকে বলয় খুলে ফেলে বর্ম পরলেন এবং কাপড় দিয়ে চুল বেঁধে নিলেন। তার পর তিনি তার অস্ত্রসমূহকে স্মরণ করলে তারা তক্ষুণি এসে উপস্থিত হোলো। তারপর গাণ্ডীব ধনুতে গুণ পরিয়ে অর্জুন সবলে আকর্ষণ করলেন। তার বজ্রের মতো টংকার শুনে কৌরবগণ বুঝলেন যে এ অর্জুনের গাণ্ডীবেরই শব্দ।

উত্তরের রথে যে পতাকা ছিল তা নামিয়ে অর্জুন বিশ্বকর্মা নির্মিত পতাকা বসালেন, যার উপরে সিংহলাঙ্গুল বানর ছিল। অগ্নিদেবের আদেশে কয়েকজন ভূতও সেই পতাকায় এসে বসলো। তার পর শমীবৃক্ষ প্রদক্ষিণ করে অর্জুন রথ নিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে গেলেন। অর্জুনের রথের ও শঙ্খের শব্দ শুনে এবং নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখে দ্রোণ বললেন, দুর্যোধন, আজ তোমার সৈন্যদল অর্জুনের বাণে বিধ্বস্ত হবে, তারা কেউ যুদ্ধ করতে চাইছে না, বহু যোদ্ধার মুখ মলিন দেখছি। তুমি গরুগুলিকে হস্তিনাপুরে পাঠিয়ে দাও, আমরা যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করি।

দুর্যোধন বললেন, পাশা খেলার সভায় এই শর্ত ছিল যে পরাজিত পক্ষ বারো বছর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবে। এখনও তেরো বছর পূর্ণ হয়নি অথচ অর্জুন উপস্থিত হয়েছে, অতএব পাণ্ডবদের আবার বারো বৎসর বনবাস করতে হবে। অজ্ঞাতবাসের সময় পূর্ণ হয়েছে না কিছুদিন এখনও বাকি আছে, তা পিতামহ ভীষ্ম বলতে পারেন। ত্রিগর্ত দেশের সেনা সপ্তমীর দিন বিরাট রাজার গরু হরণ করবে এই ঠিক ছিল। হয়তো তারা তা করেছে, অথবা পরাজিত হয়ে বিরাটের সঙ্গে সন্ধি করেছে। যে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসছে সে বোধ হয় বিরাটের কোনও যোদ্ধা কিংবা স্বয়ং বিরাট। বিরাট বা অর্জুন যিনিই আসুন, আমরা যুদ্ধ করবো। আচার্য দ্রোণ আমাদের সৈন্যের পিছনে থাকুন, ইনি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন আর অর্জুনের প্রশংসা করছেন। আচার্যরা দয়ালু হন, সর্বদাই বিপদের আশঙ্কা করেন। এঁরা রাজভবনে আর যজ্ঞ সভাতেই শোভা পান, সভায় জ্ঞানগর্ভ কথা বলতে পারেন, পরের ছিদ্র অন্বেষণে, মানুষের চরিত্র বিচারে এবং খাদ্যের দোষগুণ নির্ণয়ে এঁরা দক্ষতা দেখান। এই পণ্ডিতদের পিছনে রেখে আপনারা শত্রুবধের উপায় স্থির করুন।

কর্ণ বললেন, বিরাট বা অর্জুন যিনিই আসুন আমি শরাঘাতে বিধ্বস্ত করব। পরশুরামের কাছে যে অস্ত্র পেয়েছি তার দ্বারা এবং নিজের শক্তিতে আমি ইন্দ্রের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারি। আজ অর্জুনকে রথ থেকে মাটিতে ফেলে আমি দুর্যোধনকে খুশি করবো।

কৃপ বললেন, কর্ণ, তুমি নিষ্ঠুর স্বভাবের, সব সময় যুদ্ধ করতে চাও, তার ফল কি হবে তা ভাবো না। শাস্ত্রে অনেক প্রকার নীতির উল্লেখ আছে, তার মধ্যে যুদ্ধকেই প্রাচীন পণ্ডিতগণ সর্বাপেক্ষা পাপজনক বলেছেন। অর্জুনের সঙ্গে এখন আমাদের যুদ্ধ করা উচিত নয়। কর্ণ, অর্জুন যে সব কীর্তি করেছে তার তুলনায় তুমি কি করেছ? আমরা প্রতারণা করে তাকে তেরো বছর নির্বাসনে রেখেছি, সেই সিংহ এখন মুক্ত হয়ে কি আমাদের শেষ করবে না? আমরা সকলে মিলিত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু কর্ণ তুমি একা সাহস করো না।

অশ্বত্থামা বললেন, কর্ণ, আমরা গরু হরণ কোরে এখনও মৎস্যদেশের সীমা পার হইনি, হস্তিনাপুরেও যাইনি। তোমার প্ররোচনায় দুর্যোধন পাণ্ডবদের সম্পত্তি হরণ করেছে, কিন্তু তুমি কি কখনও সম্মুখ যুদ্ধে তাদের একজনকেও জয় করেছ? কোন্ যুদ্ধে তুমি দ্রৌপদীকে জয় করেছ, তোমার প্ররোচনায় যাঁকে একবস্ত্রে রজস্বলা অবস্থায় সভায় আনা হয়েছিল? মানুষ এবং কীট পতঙ্গ পর্যন্ত সকল প্রাণীই যথাশক্তি ক্ষমা করে, কিন্তু দ্রৌপদীকে যে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার ক্ষমা পাণ্ডবগণ কখনই করবেন না। ধর্মজ্ঞরা বলেন, শিষ্য পুত্রের চেয়ে কম নয়, এই কারণেই অর্জুন আমার পিতা দ্রোণের প্রিয়। দুর্যোধন তোমার জন্যই পাশা খেলা করিয়েছিল, তুমিই দ্রৌপদীকে সভায় আনিয়েছিলে, ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য তুমিই হরণ করেছ, এখন তুমিই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করো। দুর্যোধন, তোমার মামা দুষ্ট পাশা খেলোয়াড় শকুনিও যুদ্ধ করুন। কিন্তু জেনো, অর্জুনের গাণ্ডীব পাশার গুঁটি ফেলে না, তীক্ষ্ম বাণ বর্ষণ করে, আর সেইসকল বাণ সহজে থেমে যায় না। আচার্য দ্রোণ যদি ইচ্ছা করেন তো যুদ্ধ করুন, আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবো না। যদি মৎস্যরাজ এখানে আসতেন তবে তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করতাম।

ভীষ্ম অশ্বত্থামাকে বললেন, কর্ণ যা বলেছেন, তার উদ্দেশ্য তোমাকে যুদ্ধে উত্তেজিত করা। তুমি ক্ষমা করো, এ সময়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ হওয়া ভাল নয়, আমাদের মিলিত হয়েই যুদ্ধ করতে হবে। অশ্বত্থামা বললেন, গুরুদেব দ্রোণাচার্য কারও উপর আক্রোশের বশে অর্জুনের প্রশংসা করেন নি, কারণ, শত্রুরও গুণ বলা উচিত, গুরুরও দোষ বলা উচিত, পুত্র ও শিষ্যকে কল্যাণকর উপদেশ দেওয়া উচিত।

দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের নিকট ক্ষমা চাইলেন। কর্ণ, ভীষ্ম ও কৃপের অনুরোধে দ্রোণ প্রসন্ন হয়ে বললেন, অজ্ঞাতবাস শেষ না হলে অর্জুন আমাদের দর্শন দিতেন না। আজ গরু উদ্ধার না কোরে তিনি থামবেন না। আপনারা এমন মন্ত্রণা দিন যাতে দুর্যোধনের অখ্যাতি না হয় কিংবা পরাজিত না হন।

ভীষ্ম গণনা কোরে  বললেন, তেরো বছর পূর্ণ হয়েছে এবং তা নিশ্চিতভাবে জেনেই অর্জুন এসেছেন। পাণ্ডবগণ ধর্মজ্ঞ, তারা লোভী নন, অন্যায় উপায়ে তারা রাজ্যলাভ করতে চান না। দুর্যোধন, যুদ্ধে এক পক্ষের জীবন বা মৃত্যু, জয় বা পরাজয় অবশ্যই হয়। অর্জুন এসে পড়লেন, এখন যুদ্ধ করবে নাকি ধর্মসম্মত কাজ করবে তা সত্বর স্থির করো।

দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আমি পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেবো না, অতএব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। ভীষ্ম বললেন, তা হলে আমি যা ভালো মনে করি তা বলছি শোনো - তুমি সৈন্যদের চার ভাগের এক ভাগ নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে যাও, আর এক ভাগ গরু নিয়ে চলে যাক। অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে আমরা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবো। ভীষ্মের কথায় দুর্যোধন একদল সৈন্য নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন, গরু নিয়ে আর একদল সৈন্য রওনা হোলো। তারপর দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ ও ভীষ্ম বাকি সেনাদের নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে অর্জুন এসে দেখলেন, দ্রোণ ভীষ্ম কর্ণ প্রভৃতি রয়েছেন কিন্তু দুর্যোধন নেই। তিনি উত্তরকে বললেন, এই সৈন্যদল এখন থাকুক, আগে দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করবো। আমরা দুর্যোধনকে জয় কোরে গরু উদ্ধার করে আবার এদিকে আসবো। অর্জুনকে অন্যদিকে যেতে দেখে দ্রোণ বললেন, উনি দুর্যোধন ভিন্ন অন্য কাউকে চান না, চলো আমরা পিছনে গিয়ে ওঁকে ধরবো।

তখন অর্জুন বাণবর্ষণ কোরে কৌরব সেনাদের মূর্ছিত করলেন। তার শঙ্খ ও রথ চলার শব্দে, গাণ্ডীবের টংকারে এবং পতাকায় বসে থাকা ভূতদের গর্জনে চারদিক কাঁপতে থাকল। সেই শব্দে অপহৃত গরুর দল ভয় পেয়ে মৎস্যরাজ্যের দক্ষিণ দিকে ফিরতে লাগল। গরুগুলি উদ্ধার কোরে অর্জুন দুর্যোধনের দিকে যাচ্ছিলেন এমন সময় কৌরব পক্ষের অন্যান্য বীরগণকে দেখে তিনি উত্তরকে বললেন, কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চলো।

দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ এবং আরও কয়েকজন যোদ্ধা কর্ণকে রক্ষা করতে এলেন, কিন্তু অর্জুনের বাণে বিধ্বস্ত হয়ে পালিয়ে গেলেন। কর্ণের ভাই অর্জুনের বাণে মারা গেলেন, কর্ণও অর্জুনের বাণে বিধ্বস্ত হয়ে প্রস্থান করলেন।

অর্জুনের আদেশে উত্তর কৃপাচার্যের কাছে রথ নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর কৃপাচার্যের রথের চার ঘোড়া অর্জুনের বাণের আঘাতে লাফিয়ে উঠলে কৃপ পড়ে গেলেন। তার গৌরব রক্ষার জন্য অর্জুন আর আঘাত করলেন না, কিন্তু কৃপ আবার উঠে অর্জুনকে দশ বাণে বিদ্ধ করায় অর্জুন কৃপের কবচ, ধনু, রথ বিনষ্ট করলে অন্য যোদ্ধারা কৃপকে নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন।

দ্রোণাচার্যের সম্মুখীন হয়ে অর্জুন অভিবাদন করে স্মিতমুখে সবিনয়ে বললেন,আমরা বনবাস সমাপ্ত কোরে শত্রুর উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছি, আপনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হতে পারেন না। আপনি যদি আগে আমাকে প্রহার করেন তবেই আমি প্রহার করবো। দ্রোণ অর্জুনের প্রতি অনেকগুলি বাণ নিক্ষেপ করলেন। তখন দুজনে প্রবল যুদ্ধ হতে লাগল, অর্জুনের বাণবর্ষণে দ্রোণ মূর্ছিত হলেন। তখন অশ্বত্থামা বাধা দিতে এলেন। তিনি মনে মনে অর্জুনের প্রশংসা করলেন কিন্তু ক্রুদ্ধও হলেন। অর্জুন অশ্বত্থামার দিকে অগ্রসর হয়ে দ্রোণকে চলে যাবার পথ দিলে দ্রোণ দ্রুতবেগে চলে গেলেন।

অর্জুনের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর অশ্বত্থামার বাণ শেষ হয়ে গেল, তখন অর্জুন কর্ণের দিকে ধেয়ে গেলেন। দুজনে বহুক্ষণ যুদ্ধের পর অর্জুনের বাণ কর্ণের বুকে বিদ্ধ হোলো, তিনি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উত্তর দিকে পালিয়ে গেলেন।

তারপর অর্জুন উত্তরকে বললেন, তুমি ওই স্বর্ণময় রথের কাছে রথ নিয়ে চলো, ওখানে পিতামহ ভীষ্ম আমার প্রতীক্ষা করছেন। উত্তর বললেন, আমি হতবাক হয়েছি, আপনার বাণবর্ষণ দেখে আমার মনে হচ্ছে যেন দশ দিক ঘুরছে, ভয়ে আমার রথ চালনা করার শক্তি নেই। অর্জুন বললেন, ভয় পেয়ো না, স্থির হও, তুমিও এই যুদ্ধে খুব ভালো রথ চালিয়েছ। ধীর হয়ে রথ চালাও, ভীষ্মের কাছে আমাকে নিয়ে চলো, আজ তোমাকে আমার অসাধারণ অস্ত্রশিক্ষা দেখাব। উত্তর আশ্বস্ত হয়ে ভীষ্মের কাছে রথ নিয়ে গেলেন।

ভীষ্ম ও অর্জুন পরস্পরের প্রতি দারুণ বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। পরিশেষে ভীষ্ম অর্জুনের বাণের আঘাতে প্রায় অচেতন হলে তার সারথি তাঁকে যুদ্ধভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তার পর দুর্যোধন এসে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। তিনি বহুক্ষণ যুদ্ধের পর বাণবিদ্ধ হয়ে রক্তবমি করতে করতে পালিয়ে গেলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, পালিয়ে যাচ্ছ কেন? তোমার দুর্যোধন নাম আজ মিথ্যা হোলো, তুমি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পালাচ্ছ।

অর্জুনের কথা শুনে দুর্যোধন ফিরে এলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতিও তাঁকে রক্ষা করতে এলেন এবং অর্জুনকে ঘিরে চার দিক থেকে বাণ বর্ষণ করতে লাগলেন। তখন অর্জুন ইন্দ্রের দেওয়া সম্মোহন অস্ত্র প্রয়োগ করলে কৌরব পক্ষের সকলে অজ্ঞান হযে গেল। তখন উত্তরার অনুরোধ স্মরণ করে অর্জুন বললেন, উত্তর, তুমি রথ থেকে নেমে দ্রোণ, আর কৃপের শুভ্র বস্ত্র, কর্ণের পীত বস্ত্র এবং অশ্বত্থামা ও দুর্যোধনের নীল বস্ত্র খুলে নিয়ে এসো। ভীষ্ম বোধ হয় অজ্ঞান হননি, কারণ তিনি আমার অস্ত্র প্রতিরোধের উপায় জানেন, তুমি তার বাম দিক দিয়ে যাও। দ্রোণ প্রভৃতির বস্ত্র নিয়ে এসে উত্তর পুনর্বার রথে উঠলেন এবং অর্জুনকে নিয়ে রণভূমি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

অর্জুনকে চলে যেতে দেখে ভীষ্ম তাকে বাণ নিক্ষেপ কোরে আঘাত করলে, অর্জুন ভীষ্মের রথের ঘোড়াগুলি বধ করে তার দেহের পাশে দশটি বাণ দিয়ে আঘাত করলেন। দুর্যোধন জ্ঞান ফিরে পেয়ে বললেন, পিতামহ, অর্জুনকে অস্ত্রাঘাত করুন, যেন ও চলে যেতে না পারে। ভীষ্ম হেসে বললেন, তোমার বুদ্ধি আর বিক্রম এতক্ষণ কোথায় ছিল? তুমি যখন ধনুর্বাণ ত্যাগ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলে তখন অর্জুন তোমার প্রতি কোনও নৃশংসতা করেননি, তিনি কখনও স্বধর্ম ত্যাগ করেন না, তাই তোমরা সকলে এই যুদ্ধে নিহত হওনি। এখন তুমি নিজের দেশে ফিরে যাও, অর্জুনও গরু নিয়ে প্রস্থান করুন। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যুদ্ধের ইচ্ছা ত্যাগ করে নীরব হলেন, অন্যান্য সকলেই ভীষ্মের কথায় রাজি হয়ে দুর্যোধনকে নিয়ে ফিরে যেতে চাইলেন।

কৌরবগণ চলে যাচ্ছেন দেখে অর্জুন খুশি হলেন এবং গুরুজনদের সম্মান প্রদর্শন করলেন। তিনি পিতামহ ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যকে প্রণাম জানালেন, অশ্বত্থামা, কৃপ ও মাননীয় কৌরবগণকে বিচিত্র বাণ দিয়ে অভিবাদন করলেন এবং বাণের আঘাতে দুর্যোধনের রত্নময় মুকুট কেটে দিলেন। তার পর অর্জুন উত্তরকে বললেন, রথ ঘুরিয়ে নাও, তোমার গরু উদ্ধার হয়েছে এখন আনন্দে রাজধানীতে ফিরে চলো।

যে সব কৌরবসৈন্য পালিয়ে গিয়ে বনে লুকিয়েছিল, তারা কাতর হয়ে কম্পিতদেহে অর্জুনকে প্রণাম করে বললো, আমরা এখন কি করবো? অর্জুন তাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, তোমাদের মঙ্গল হোক, তোমরা নির্ভয়ে ফেরে যাও। তারা অর্জুনের আয়ু, কীর্তি ও যশ বৃদ্ধির আশীর্বাদ কোরে চলে গেল।

অর্জুন উত্তরকে বললেন, তুমি রাজধানীতে গিয়ে তোমার পিতার কাছে এখন আমাদের পরিচয় দিও না, তা হলে তিনি ভয় পাবেন। তুমি নিজেই যুদ্ধ কোরে কৌরবদের পরাস্ত করেছ এবং গরু উদ্ধার করেছ এই কথা বলো। উত্তর বললেন, আপনি যা করেছেন তা আর কেউ পারে না, আমার তো সে শক্তি নেইই। তথাপি আপনি আদেশ না দিলে আমি পিতাকে প্রকৃত ঘটনা জানাব না।

অর্জুন ক্ষতদেহে শ্মশানের কাছে শমীবৃক্ষের নিকটে এলেন। অর্জুনের কথায় উত্তর পাণ্ডবগণের অস্ত্রাদি শমীবৃক্ষে রেখে রথ চালালেন। নগরের পথে এসে অর্জুন বললেন, গোপালকগণ তোমাদের সমস্ত গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখানে ঘোড়াদের স্নান করিয়ে জল খাইয়ে বিশ্রামের পর বিকালে বিরাটনগরে যাবো। তুমি কয়েকজন গোপকে বলে দাও তারা শীঘ্র নগরে গিয়ে তোমার জয় ঘোষণা করুক। অর্জুন আবার বৃহন্নলার বেশ ধারণ করলেন এবং বিকালে  উত্তরের সারথি হয়ে বিরাটনগরে যাত্রা করলেন।

ওদিকে বিরাট রাজা ত্রিগর্ত দেশের রাজাকে পরাজিত কোরে চার জন পাণ্ডবের সঙ্গে রাজধানীতে ফিরে এলেন। তিনি শুনলেন, কৌরবরা রাজ্যের উত্তর দিকে এসে গরু হরণ করেছে আর রাজকুমার উত্তর বৃহন্নলাকে সঙ্গে নিয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, দুর্যোধন ও অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছেন। বিরাট অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর সৈন্যদলকে বললেন, তোমরা শীঘ্র গিয়ে দেখ উত্তর জীবিত আছেন কিনা। নপুংসক যার সারথি তার বাঁচা অসম্ভব মনে করি। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, বৃহন্নলা যদি সারথি হয় তবে শত্রুরা আপনার গরু নিতে পারবে না, তার সাহায্যে আপনার পুত্র কৌরবগণকে এমন কি দেবতা ও অসুর প্রভৃতিকেও জয় করতে পারবেন।

এমন সময় উত্তরের দূতরা এসে বিজয়সংবাদ দিলে বিরাট আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে মন্ত্রীদের আদেশ দিলেন, রাজপথ পতাকা দিয়ে সাজাও, দেবতাদের পূজা দাও, কুমারগণ যোদ্ধাগণ ও সালংকারা গণিকাগণ বাজনা বাজিয়ে আমার পুত্রকে স্বাগত করুক, হাতির উপরে ঘণ্টা বাজিয়ে সমস্ত জায়গায় আমার জয় ঘোষণা করা হোক, উত্তম পোশাকে সেজে বহু কুমারীদের সঙ্গে উত্তরা বৃহন্নলাকে আনতে যাক। তার পর বিরাট বললেন, সৈরিন্ধ্রী, পাশা নিয়ে এসো আমি আর কঙ্ক পাশা খেলব। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, শুনেছি আনন্দের সময় পাশা খেলা অনুচিত। পাশা খেলায় বহু দোষ, তা বর্জন করাই ভালো। যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে থাকবেন, তিনি তার বিশাল রাজ্য এবং দেবতুল্য ভাইদেরও পাশা খেলায় হারিয়েছিলেন। তবে আপনি যদি নিতান্ত খেলতে চান তবে খেলব।

পাশা খেলতে খেলতে বিরাট বললেন, দেখো, আমার পুত্র কৌরববীরগণকেও জয় করেছে। যুধিষ্ঠির বললেন, বৃহন্নলা যার সারথি সে জয়ী হবে। বিরাট ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, নীচ ব্রাহ্মণ, তুমি আমার পুত্রের সমান জ্ঞান কোরে একটা নপুংসকের প্রশংসা করছ, কাকে কি বলতে হয় তা তুমি জানো না, আমার অপমান করছ। নপুংসক কি করে ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতিকে জয় করতে পারে? তুমি আমার সখা সেজন্য অপরাধ ক্ষমা করলাম, যদি বাঁচতে চাও তবে আর এমন কথা বলো না। যুধিষ্ঠির আবার বললেন, মহারাজ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতি মহারথগণের সঙ্গে বৃহন্নলা ভিন্ন আর কে যুদ্ধ করতে পারেন? ইন্দ্রাদি দেবগণও পারেন না। বিরাট বললেন, বহুবার নিষেধ করলেও তুমি একই কথা বলছ, শাসন না করলে কেউ ধর্মপথে চলে না। এই বলে বিরাট অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরের মুখে পাশা দিয়ে আঘাত করলেন। যুধিষ্ঠিরের নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল, তিনি হাত দিয়ে তা ধরে দ্রৌপদীর দিকে চাইলেন। দ্রৌপদী তখনই একটি জলপূর্ণ পাত্র এনে যুধিষ্ঠিরের রক্ত ধরলেন। এই সময়ে দ্বারপাল এসে সংবাদ দিলে যে রাজপুত্র উত্তর এসেছেন, তিনি বৃহন্নলার সঙ্গে দ্বারে অপেক্ষা করছেন। বিরাট বললেন, তাঁদের শীঘ্র নিয়ে এসো।

অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ছিল যে কোনও লোক যদি যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কারণে যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত করে তবে সে জীবিত থাকবে না। এই প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে যুধিষ্ঠির দ্বারপালকে বললেন, কেবল উত্তরকে নিয়ে এস, বৃহন্নলাকে নয়। উত্তর এসে পিতাকে প্রণাম করে দেখলেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এক প্রান্তে ভূমিতে বসে আছেন, তার নাসক দিয়ে রক্ত পড়ছে, দ্রৌপদী তার কাছে রয়েছেন। উত্তর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজ, কে এই পাপকাজ করেছে? বিরাট বললেন আমি এই কুটিলকে প্রহার করেছি, এ আরও শাস্তির যোগ্য, তোমার প্রশংসা করায় এ একটা নপুংসকের প্রশংসা করছিল। উত্তর বললেন, মহারাজ, আপনি অন্যায় কাজ করেছেন, শীঘ্র এঁকে প্রসন্ন করুন, ইনি যেন ব্রহ্মশাপে আপনাকে সবংশে বিনাশ না করেন। পুত্রের কথায় বিরাট যুধিষ্ঠিরের নিকট ক্ষমা চাইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা, আমি পূর্বেই ক্ষমা করেছি, আমার ক্রোধ নেই। যদি আমার রক্ত ভূমিতে পড়ত তবে আপনি রাজ্য সমেত বিনষ্ট হতেন।

যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত থামলে অর্জুন এলেন এবং প্রথমে রাজাকে তার পর যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করলেন। বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিরাট তাঁর পুত্রকে বললেন, বৎস, তোমার তুল্য পুত্র আমার হয়নি, হবেও না। মহাবীর কর্ণ, যমরাজের মতো ভয়ঙ্কর ভীষ্ম, ক্ষত্রিয়গণের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, মহাবল দুর্যোধন — এঁদের সঙ্গে তুমি কি করে যুদ্ধ করলে? এইসকল মহাবীরকে পরাজিত করে তুমি গরু উদ্ধার করেছ, যেন সিংহের কবল থেকে মাংস কেড়ে এনেছ।

উত্তর বললেন, আমি গোধন উদ্ধার করি নি, শত্ৰুজয়ও করি নি। আমি ভয় পেয়ে পালাচ্ছিলাম, এক দেবপুত্র আমাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনিই রথে উঠে ভীষ্মদি ছয় রথীকে পরাস্ত করে সমস্ত গরু উদ্ধার করেছেন। সিংহের ন্যায় সেই যুবক কৌরবগণকে উপহাস করে তাদের বসন হরণ করেছেন। বিরাট বললেন, সেই মহাবীর দেবপুত্র কোথায় ? উত্তর বললেন, পিতা, তিনি চলে গেছেন, বোধ হয় কাল পরশু দেখা দেবেন।

বৃহন্নলাবেশী অর্জুন বিরাটের অনুমতি নিয়ে তাঁর কন্যা উত্তরাকে কৌরবগণের মহার্ঘ্য বিচিত্র বসনগুলি দিলেন। তার পর তিনি নির্জনে উত্তরের সঙ্গে মন্ত্রণা করে যুধিষ্ঠিরাদির আত্মপ্রকাশের উদ্যোগ করলেন।

______________

(ক্রমশ)