মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৭৫
পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের কাহিনি
পাণ্ডবগণ তাদের সঙ্গে থাকা তপস্বিগণকে বললেন, আপনারা জানেন যে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা কপট পাশা খেলায় আমাদের রাজ্য হরণ করেছে, বহু দুঃখও দিয়েছে। আমার বারো বছর বনবাসে অনেক কষ্টে বসবাস করেছি, এখন শেষ তেরোতম বছর উপস্থিত হয়েছে। আপনারা অনুমতি দিন, আমার এখন অজ্ঞাতবাস করবো। দুরাত্মা দুর্যোধন, কর্ণ আর শকুনি যদি আমাদের সন্ধান পায় তবে আমাদের ভয়ানক ক্ষতি করবে।
যুধিষ্ঠির বললেন, এমন দিন কি হবে যখন আমরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আবার নিজ রাজ্যে বাস করতে পারবো? ধৌম্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিলেন। ভীম বললেন, মহারাজ, আপনার আদেশের প্রতীক্ষায় আমার এযাবৎ কোনও দুঃসাহসের কাজ করিনি। আপনি যে কাজে আমাদের নিযুক্ত করবেন আমরা তা অবশ্যই করবো। আপনি আদেশ দিলে আমরা অবিলম্বে শত্ৰুজয় করবো।
আশ্রমের ব্রাহ্মণগণ এবং মুনিগণ পাণ্ডবগণকে আশীর্বাদ কোরে আবার দর্শনের ইচ্ছা জানিয়ে চলে গেলেন। তার পর পঞ্চপাণ্ডব ধনুর্বাণ নিয়ে দ্রৌপদী ও পুরোহিত ধৌম্যের সঙ্গে যাত্রা করলেন এবং এক ক্রোশ দূরে এক জায়গায় এসে অজ্ঞাতবাসের আলোচনার জন্য বসলেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা রাজ্যত্যাগ করে বারো বছর বনবাসে আছি, এখন তেরোতম বছর শুরু হয়েছে। এই শেষ বছর অত্যন্ত সাবধানে কাটাতে হবে। অর্জুন, তুমি এমন দেশের নাম বলো যেখানে আমরা অজ্ঞাতবাস করতে পারবো। অর্জুন বললেন, যক্ষরূপী ধর্ম যে বর দিয়েছেন তার প্রভাবেই আমরা অজ্ঞাতভাবে বিচরণ করতে পারব, তবুও কয়েকটি দেশের নাম বলছি -কুরুদেশের চারদিকে অনেক দেশ আছে, যেমন পাঞ্চাল, চেদি, মৎস্য, শূরসেন, পটচ্চর, দশার্ণ, মল্ল, শাম্ব, যুগন্ধর, কুন্তিরাষ্ট্র, সুরাষ্ট্র, অবন্তী। এদের মধ্যে কোনটি আপনার ভাল মনে হয়? যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যদেশের রাজা বিরাট বলবান ধর্মশীল দানশীল ও বৃদ্ধ, তিনি আমাদের রক্ষা করতে পারবেন, আমরা এক বছর বিরাটনগরে তার কর্মচারী হয়ে থাকব।
অর্জুন বললেন, মহারাজ, আপনি কোমল স্বভাব, লজ্জাশীল ও ধার্মিক, সামান্য লোকের মতো পরের গৃহে কি কাজ করবেন? যুধিষ্ঠির বললেন, বিরাট রাজা পাশা খেলা ভালোবাসেন, আমি কঙ্ক নাম নিয়ে ব্রাহ্মণরূপে তার সভাসদ হবো। তিনি জিজ্ঞাসা করলে বলবো যে আগে আমি যুধিষ্ঠিরের প্রিয় সখা ছিলাম। ভীম, বিরাটনগরে তুমি কোন্ কাজ করবে?
ভীম বললেন, আমি বল্লভ নাম নিয়ে রাজার পাকশালায পাচক হবো, রান্নার কাজে দক্ষতা দেখিয়ে তার পাচকদের হারিয়ে দেবো। তা ছাড়া আমি রাশি রাশি কাঠ বয়ে আনব, প্রয়োজন হলে বলবান হাতি বা ষাঁড়কে দমন করবো। যদি কেউ আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে চায় তবে তাদের হারিয়ে দেবো, কিন্তু বধ করবো না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমি রাজা যুধিষ্ঠিরের হাতি বা ষাঁড়কে দমন করতাম এবং তার পাচক ও মল্লযোদ্ধা ছিলাম।
যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন বললেন, আমি বৃহন্নলা নাম নিয়ে নপুংসক সেজে যাবো, বাহুতে যে তীর চালানোর চিহ্ন আছে তা বলয় দিয়ে ঢাকব, কানে কুণ্ডল এবং হাতে শাঁখা পরবো, চুলে বেণী বাঁধব, এবং রাজভবনের স্ত্রীদের নাচ, গান ও বাজনা শেখাবো। জিজ্ঞাসা করলে বলবো, আমি দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলাম।
নকুল বললেন, আমি ঘোড়ার রক্ষা ও চিকিৎসায় দক্ষ, গ্রন্থিক নাম নিয়ে আমি বিরাটরাজার ঘোড়ার রক্ষক হবো। নিজের পরিচয় এই দেবো যে পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের ঘোড়ার রক্ষক ছিলাম।
সহদেব বললেন, আমি তন্তিপাল নাম নিয়ে বিরাট রাজার সমস্ত গরু দেখাশোনা করবো। আমি গরুর দোহন পদ্ধতি ও চিকিৎসা জানি, সুলক্ষণ ষাঁড়ও চিনতে পারি।
যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের স্ত্রী দ্রৌপদী প্রাণের অপেক্ষা প্রিয়, মায়ের ন্যায় পালনীয়া, বড় বোনের মতো মাননীয়া। ইনি সেখানে কোন্ কর্ম করবেন? দ্রৌপদী কোমল, অভিমানিনী, জন্মাবধি বিবিধ মূল্যবান বেশভূষায় অভ্যস্ত। দ্রৌপদী বললেন, যে নারী স্বাধীনভাবে পরের বাড়িতে দাসীর কাজ করে তাকে সৈরিন্ধ্রী বলা হয়। চুলের পরিচর্যায় নিপুণ সৈরিন্ধ্রীর রূপে আমি যাবো, বলব যে পূর্বে আমি দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলাম। রানী সুদেষ্ণা আমাকে আশ্রয় দেবেন, তুমি ভেবো না। যুধিষ্ঠির বললেন, কল্যাণী, তোমার পরিকল্পনা ভালো। মহান রাজবংশে তোমার জন্ম, তুমি পাপ কাজ করতে জানো না। এমন ভাবে থেকো যাতে পাপাত্মা শত্রুরা সুখী না হয়, তোমাকে কেউ যেন জানতে না পারে।
পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী নিজেদের কাজ ঠিক করার পর যুধিষ্ঠির বললেন, পুরোহিত ধৌম্য দ্রুপদ রাজার ভবনে যান এবং সেখানে অগ্নিহোত্র রক্ষা করুন আর সঙ্গে সারথি, পাচক আর দ্রৌপদীর পরিচারিকারাও যাক। রথগুলি নিয়ে ইন্দ্রসেন প্রভৃতি দ্বারকায় চলে যাক। কেউ প্রশ্ন করলে সকলেই বলবে, পাণ্ডবরা কোথায় গেছেন, তা আমরা জানি না।
ধৌম্য বললেন, পাণ্ডবগণ, তোমরা ব্রাহ্মণ, শুভাকাঙ্খী, রথ, অস্ত্রাদি এবং অগ্নিহোত্র রক্ষার ব্যবস্থা করলে। যুধিষ্ঠির ও অর্জুন সর্বদা দ্রৌপদীকে রক্ষা করবেন। এখন তোমাদের এক বছর অজ্ঞাতবাস করতে হবে। তোমরা জানো, তবুও রাজভবনে কেমন আচরণ করতে হয় তা আমি বলছি - আমি রাজার প্রিয় এই কথা ভেবে রাজার আসন, হাতি বা রথে ব্যবহার করা অনুচিত। রাজা জিজ্ঞাসা না করলে তাকে উপদেশ দেবে না। রাজার পত্নী, যারা অন্তঃপুরে থাকে, এবং যাদেরকে রাজা পছন্দ করেন না, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে না। অতি সামান্য কাজও রাজাকে জানিয়ে করবে। মতামত প্রকাশ করবার সময় রাজার জন্য যা কল্যাণকর ও প্রিয় তাই বলবে। মিতবাক হয়ে রাজার ডান বা বাম পাশে বসবে, রাজার পিছন দিক অস্ত্রধারী রক্ষীদের স্থান। রাজার সামনে কখনো বসবে না। রাজা মিথ্যা কথা বললে তা প্রকাশ করবে না। আমি বীর বা বুদ্ধিমান এই বলে গর্ব করবে না, পছন্দের কাজ করলেই রাজার প্রিয় হওয়া যায়। রাজার সামনে জোরে কথা বলবে না। কৌতুকজনক কোনও আলোচনা হলে পাগলের মতো জোরে হাসবে না। যিনি কোনো কিছু লাভ করলে আনন্দ এবং অপমানে দুঃখ না দেখিয়ে নির্বিকার থাকেন, রাজা কোনও কাজের ভার দিলে যিনি বিচলিত হন না, তিনিই রাজভবনে বাস করতে পারেন। রাজা যে বস্ত্র ও অলংকারাদি দান করেন তা রোজ ব্যবহার করলে রাজার প্রিয় হওয়া যায়। বৎস যুধিষ্ঠির, তোমরা এইভাবে এক বছর বিরাট রাজার ভবনে বাস কোরো।
যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি যে সদুপদেশ দিলেন তা মা কুন্তী ও মহামতি বিদুর ছাড়া আর কেউ দিতে পারেন না। তার পর ধৌম্য পাণ্ডবগণের সমৃদ্ধি কামনায় মন্ত্রপাঠ করে অগ্নিতে আহুতি দিলেন। হোমাগ্নি ও ব্রাহ্মণগণকে প্রদক্ষিণ করে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করলেন।
পাণ্ডবেরা যমুনার দক্ষিণ তীরে দিয়ে হেঁটে চললেন। দুর্গম পর্বত ও বন অতিক্রম করে দশার্ণ দেশের উত্তর, পাঞ্চালের দক্ষিণ এবং শূরসেন দেশের মধ্য দিয়ে পাণ্ডবগণ মৎস্য দেশে উপস্থিত হলেন। তাদের বর্ণ মলিন, মুখে দাড়ি, হাতে ধনু, কোমরে খড়্গ। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, আমরা ব্যাধ। বিরাট রাজার রাজধানীর কাছে এসে দ্রৌপদী অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, যুধিষ্ঠিরের আদেশে অর্জুন তাকে কাঁধে নিয়ে চলতে লাগলেন। রাজধানীতে উপস্থিত হয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা যদি সশস্ত্র হয়ে নগরে প্রবেশ করি তবে লোকে ভয় পাবে, অর্জুনের গাণ্ডীব ধনু অনেকেই জানে, তা দেখে আমাদের চিনে ফেলবে। অর্জুন বললেন, শ্মশানের কাছে পর্বতশৃঙ্গে ওই যে বিরাট শমীবৃক্ষ রয়েছে তাতে আমাদের অস্ত্র গোপন কোরে রাখলে কেউ নিতে সাহস করবে না। তখন পাণ্ডবগণ তাঁদের ধনুর সঙ্গে সমস্ত অস্ত্র বাঁধলেন। নকুল শমীবৃক্ষে উঠে একটি মজবুত শাখায় অস্ত্রগুলি এমনভাবে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলেন যাতে বৃষ্টিতে ভিজে না যায়। তার পর তিনি একটি মৃতদেহ সেই গাছে বেঁধে দিলেন, যাতে মৃতদেহের দুর্গন্ধ পেয়ে লোকে কাছে না আসে। গরু ও ভেড়ার পালকদের প্রশ্নের উত্তরে তারা বললেন, ইনি আমাদের মা, মৃতদেহ গাছে বেঁধে রাখাই আমাদের বংশের নিয়ম।
যুধিষ্ঠির নিজেদের এই পাঁচটি গুপ্ত নাম রাখলেন — জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়সেন ও দেবল। তার পর সকলে সেই বিরাট রাজার নগরে প্রবেশ করলেন।
বিরাট রাজার সভায় প্রথমে ব্রাহ্মণবেশী যুধিষ্ঠির উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে বিরাট তার সভাসদগণকে বললেন ইনি কে? এঁকে দেখে ব্রাহ্মণ মনে হয় না, বরং কোনও রাজা মনে হয়। সঙ্গে হাতি, ঘোড়া, রথ না থাকলেও এঁকে দেবরাজ ইন্দ্রের মতো দেখাচ্ছে। যুধিষ্ঠির নিকটে এসে বললেন মহারাজ, আমি ব্রাহ্মণ, আমার সর্বস্ব বিনষ্ট হয়েছে, জীবিকার জন্য আপনার কাছে এসেছি। পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের সখা ছিলাম। আমার নাম কঙ্ক, আমি পাশা খেলায় দক্ষ।
বিরাট বললেন, যা চাও তাই তোমাকে দেব, তুমি রাজা হবার যোগ্য। পাশা খেলোয়াড়গণ আমার প্রিয়। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজন, আমাকে কথা দিন যেন পাশা খেলায় নীচ লোকের সঙ্গে আমার যেন বিবাদ না হয়, এবং আমি যাকে পরাজিত করবো সে তার ধন আটকে রাখতে পারবে না। বিরাট বললেন, কেউ যদি তোমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে তবে তাকে নিশ্চয় শাস্তি দেবো, যদি সে ব্রাহ্মণ হয় তবে তাকে নির্বাসিত করবো। প্রজাগণ শোন, যেমন আমি তেমনই কঙ্ক এই রাজ্যের প্রভু। কঙ্ক, তুমি আমার সখা এবং আমার সমান, তুমি প্রচুর পানভোজন ও বস্ত্র পাবে, আমার ভবনের ভিতরে বাইরে সব জায়্গায় তুমি যেতে পারবে, কেউ যদি অর্থাভাবের জন্য তোমার কাছে কেউ কিছু প্রার্থনা করে তবে আমাকে জানালে আমি তাকে দান করবো।
তারপর ভীম বিরাট রাজার সভায় এলেন, তাঁর পরনে কালো পোশাক, হাতে খুন্তি ও খোলা তরবারি। বিরাট সভার লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, সিংহের মতো বলবান ও অতি রূপবান এই যুবক কে? ভীম কাছে এসে নম্রভাবে বললেন, মহারাজ, আমি পাচক, আমার নাম বল্লভ, আমি উত্তম রান্না করতে পারি, রাজা যুধিষ্ঠির আমার রান্না করা নানা খাদ্য ভোজন করতেন। আমার মতো বলবান কেউ নেই, আমি বাহুযুদ্ধে পটু, হাতি ও সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ কোরে আমি আপনাকে খুশি করবো। বিরাট বললেন, তোমাকে আমি রান্নার কাজে নিযুক্ত করলাম, সেখানে যেসব পাচক আছে তুমি তাদের প্রধান হবে। যদিও এই কাজ তোমার উপযুক্ত নয়, তুমি সমগ্র পৃথিবীর রাজা হবার যোগ্য।
অপূর্ব সুন্দরী দ্রৌপদী তাঁর কুঞ্চিত চুল মাথার ডান পাশে তুলে কালো পোশাক দিয়ে ঢেকে বিচরণ করছিলেন। বিরাট রাজার পত্নী সুদেষ্ণা প্রাসাদের উপর থেকে দেখতে পেয়ে তাকে ডেকে আনালেন এবং জিজ্ঞাস করলেন, তুমি কে, কি চাও? দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, মহারানী, আমি সৈরিন্ধ্রী, যিনি আমাকে নিয়ুক্ত করবেন আমি তাঁর কাজ করবো। সুদেষ্ণা বললেন, কল্যাণী, তুমি নিজেই দাসদাসীকে আদেশ দেবার যোগ্য। তুমি দেবীর মতো সুদর্শনা। তুমি কে? যক্ষী, দেবী, গন্ধর্বী না অপ্সরা?
দ্রৌপদী বললেন, সত্য বলছি আমি সৈরিন্ধ্রী। কেশ পরিচর্যা, চন্দন লেপন, বিচিত্র মালা গাঁথা প্রভৃতি কাজ জানি। আমি পূর্বে কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা এবং পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদীর পরিচর্যা করতাম। তাদের কাছে আমি উত্তম খাদ্য ও প্রয়োজনীয় বসন পেতাম। দেবী সত্যভামা আমার নাম মালিনী রেখেছিলেন। সুদেষ্ণা বললেন, রাজা যদি তোমার প্রতি আকর্ষিত না হন তবে আমি তোমাকে মাথায় করে রাখব। এই রাজভবনে যে সকল নারী আছে তারা একদৃষ্টিতে তোমাকে দেখছে, পুরুষরা তোমাকে দেখে মোহিত হবে। সুন্দরী, তোমার অপূর্ব রূপ দেখলে বিরাট রাজা আমাকে ত্যাগ করে তোমাতে আসক্ত হবেন। দ্রৌপদী বললেন, বিরাট রাজা বা অন্য কেউ আমাকে পাবেন না, কারণ পাঁচজন মহাবলশালী গন্ধর্ব যুবক আমার স্বামী, তারা সর্বদা আমাকে রক্ষা করেন। আমি এখন ব্রতপালনের জন্যই কষ্ট স্বীকার করছি। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দেন না এবং আমাকে দিয়ে পদসেবা করান না, তাঁর উপর আমার গন্ধর্ব পতিরা খুশি হন। কোনো পুরুষ যদি আমাকে কামনা করে তবে সে অবিলম্বে পরলোকে যায়। সুদেষ্ণা বললেন, তুমি যেমন চাও সেই ভাবেই তোমাকে রাখব, কারও পা বা উচ্ছিষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে হবে না।
তারপর সহদেব গোপালকের বেশ ধারণ করে বিরাটের সভায় এলেন। রাজা বললেন, তুমি কে, কোথা থেকে আসছ, কি চাও? সহদেব উত্তর দিলেন, আমার নাক অরিষ্টনেমি, আগে আমি পাণ্ডবদের গবাদি পশুর পরীক্ষক ছিলাম। তারা এখন কোথায় গেছেন জানি না, আমি আপনার কাছে থাকতে চাই। যুধিষ্ঠিরের বহু লক্ষ গাভী ও বলদ ছিল, আমি তাদের পরীক্ষা করতাম। লোকে আমাকে তন্তিপাল বলত। আমি গবাদি পশুর ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলতে পারি, যে উপায়ে গরুর বংশ বৃদ্ধি হয় এবং রোগ না হয় তাও জানি। আমি সুলক্ষণ ষাঁড় চিনতে পারি। বিরাট বললেন, আমার বিভিন্ন জাতীয় এক এক লক্ষ পশু আছে। সেই সমস্ত পশুর ভার তোমার হাতে দিলাম, তাদের পালকগণ তোমার অধীন থাকবে।
তার পর সভাস্থ সকলে দেখলেন, একজন রূপবান বিশালকায় পুরুষ আসছেন, তাঁর কানে কুণ্ডল, হাতে শঙ্খ ও সোনার তৈরী বালা, মাথায় লম্বা খোলা চুল। নপুংসকবেশী অর্জুনকে বিরাট বললেন, তুমি হাতিদের দলপতির মতো বলবান সুদর্শন যুবক, অথচ হাতে বালা এবং কানে কুণ্ডল পরে খোলা চুলে এসেছ। যদি রথে চড়ে যোদ্ধার বেশে কবচ ও ধনুর্বাণ ধারণ করে আসতে তবেই তোমাকে মানাত। তোমার মত লোক নপুংসক হতে পারে না এই আমার বিশ্বাস।
অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমি নাচ, গান, বাজনায় পারদর্শী, আপনার কন্যা উত্তরার শিক্ষার ভার আমাকে দিন। আমার এই নপংসক রূপ কেন হয়েছে সেই দুঃখময় বৃত্তান্ত আপনাকে পরে বলবো। আমার নাম বৃহন্নলা, আমি পিতৃমাতৃহীন, আমাকে আপনার পুত্র বা কন্যা জ্ঞান করবেন। রাজা বললেন, বৃহন্নলা, তোমার ইচ্ছা মতো কাজের ভার তোমাকে দিলাম, তুমি আমার কন্যা এবং অন্যান্য কুমারীদের নাচ-গান শেখাও। তারপর বিরাট রাজা অর্জুনের নপুংসকত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে তাকে অন্দরে পাঠিয়ে দিলেন। অর্জুন রাজকন্যা উত্তরা ও তার সহচরীদের নাচ, গান, বাজনা শিখিয়ে তাদের প্রীতিভাজন হলেন।
তার পর উজ্জ্বল সূর্যের মতো নকুলকে আসতে দেখে মৎস্যরাজ বিরাট বললেন, এই দেবতুল্য পুরুষটি কে? এ আগ্রহ সহকারে আমার ঘোড়াদের দেখছে, নিশ্চয় এই লোক ঘোড়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। রাজার কাছে এসে নকুল বললেন, মহারাজের জয় হোক, সকলের শুভ হোক। আমি যুধিষ্ঠিরের সমস্ত ঘোড়ার দেখাশোনা করতাম, আমার নাম গ্রন্থিক। ঘোড়ার স্বভাব, শিক্ষাদান, চিকিৎসা এবং দুষ্ট ঘোড়াকে আয়ত্ব করার বিদ্যা আমার জানা আছে। বিরাট বললেন, আমার যত ঘোড়া আছে সে সকলের দেখাশোনার ভার তোমাকে দিলাম, সারথি প্রভৃতিও তোমার অধীন হবে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন যুধিষ্ঠিরের দর্শন পেয়েছি।
সাগরের সীমা পর্যন্ত পৃথিবীর যাঁরা অধিপতি ছিলেন সেই পাণ্ডবগণ এইরূপে কষ্ট স্বীকার কোরে মৎস্যরাজ্যে অজ্ঞাতবাস করতে লাগলেন।
______________
(ক্রমশ)