মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৭০
জয়দ্রথের দ্রৌপদীহরণ, ভীমের হাতে জয়দ্রথের নিগ্রহ ও পরে মুক্তির কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
জয়দ্রথের দ্রৌপদীহরণ, ভীমের হাতে জয়দ্রথের নিগ্রহ ও পরে মুক্তির কাহিনি
একদিন পঞ্চপাণ্ডব মহর্ষি ধৌম্যের অনুমতি নিয়ে দ্রৌপদীকে আশ্রমে রেখে বিভিন্ন দিকে শিকার করতে গেলেন। সেই সময়ে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ কাম্যকবনে উপস্থিত হলেন। তিনি বিবাহ করার উদ্দেশ্যে শাম্বরাজ্যে যাচ্ছিলেন, অনেক রাজা তাঁর সহযাত্রী ছিলেন। দ্রৌপদীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে জয়দ্রথ তার সঙ্গী রাজা কোটিকাস্যকে বললেন, এই সুন্দরী কে? এঁকে পেলে আমার আর বিবাহের প্রয়োজন নেই। তুমি জেনে এস ইনি কে আর এঁর রক্ষক কে। এই অপূর্ব সুন্দরী কি আমাকে বিবাহ করবেন? শিয়াল যেমন বাঘিনীর কাছে যায় সেইরূপ কোটিকাস্য দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, সুন্দরী, কে তুমি একাকিনী দাঁড়িয়ে আছ? তুমি কার কন্যা, কার পত্নী? এখানে কি করছ? আমি সুরথ রাজার পুত্র কোটিকাস্য। বারো জন রাজপুত্র এবং বহু রথ, হাতি, ঘোড়া ও পদাতিক যাঁর সঙ্গে গমন করছেন তিনি সৌবীররাজ জয়দ্রথ। আরও অনেক রাজা ও রাজপুত্র তাঁর সঙ্গে আছেন। দ্রৌপদী বললেন, এখানে আর কেউ নেই, তাই আমিই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আমি দ্রুপদরাজকন্যা দ্রৌপদী, পঞ্চপাণ্ডব আমার স্বামী, তারা এখন শিকার করতে গেছেন। আপনারা যানবাহন থেকে নেমে আসুন, অতিথিপ্রিয় ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আপনাদের দেখে খুশি হবেন।
কোটিকাস্যের কাছে দ্রৌপদীর কথা শুনে জয়দ্রথ বললেন, আমি সত্য বলছি, এই নারীকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য নারীরা বানরী। এই বলে তিনি ছয় জন সহচরের সঙ্গে আশ্রমে প্রবেশ করে দ্রৌপদীকে কুশল প্রশ্ন করলেন। দ্রৌপদী আসন দিয়ে বললেন, রাজকুমার, আপনাদের ভোজনের জন্য আমি পঞ্চাশটি হরিণ দিচ্ছি, যুধিষ্ঠির এলে আরও অনেক হরিণ, খরগোশ, বানর, শম্বর, গরু, শুয়োর, মহিষ প্রভৃতি দেবেন। জয়দ্রথ বললেন, তুমি আমাকে খাবার দিতে চেয়েছ, কিন্তু আমার খাবার চাই না, তুমি এখন আমার রথে ওঠো, রাজ্যহীন দরিদ্র পাণ্ডবদের জন্য তোমার অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তুমি আমার পত্নী হও।
জয়দ্রথের কথায় দ্রৌপদী ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, তুমি পাষণ্ড, যশস্বী মহারথ পাণ্ডবদের নিন্দা করতে তোমার লজ্জা হয় না? অত্যন্ত নরাধম লোকেই এমন কথা বলে। তুমি ঘুমন্ত সিংহ আর বিষধর সাপকে পদাঘাত করতে চেয়েছ। জয়দ্রথ বললেন, দ্রৌপদী, পাণ্ডবরা কেমন তা আমি জানি, তুমি আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না, এখন তাড়াতাড়ি এই রথে ওঠো অথবা মিনতি কোরে আমার অনুগ্রহ ভিক্ষা করো। দ্রৌপদী বললেন, আমি অবলা নই, তোমার মতো পাষণ্ডের কাছে মিনতি করবো না। তুমি যখন অর্জুনের বাণবর্ষণ, ভীমের গদাঘাত এবং নকুল-সহদেবের ক্রোধ দেখবে তখন নিজের অপকর্মের জন্য আপশোষ করবে।
দ্রৌপদীর কথা শুনে জয়দ্রথ তাকে ধরতে এলে দ্রৌপদী তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন এবং পুরোহিত ধৌম্যকে ডাকতে লাগলেন। জয়দ্রথ ভূমি থেকে উঠে দ্রৌপদীকে সবলে রথে তুললেন। ধৌম্য এসে বললেন, জয়দ্ৰথ, তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন কর, মহাবল পাণ্ডবদের পরাজিত না করে তুমি এঁকে নিয়ে যেতে পারো না। এই নীচ কর্মের ফল তোমাকে নিশ্চয়ই ভোগ করতে হবে। এই বলে ধৌম্য পদাতিক সৈন্যের সঙ্গে মিশে দ্রৌপদীর পশ্চাতে চললেন।
পাণ্ডবগণ শিকার শেষ করে বিভিন্ন দিক থেকে এসে একত্র মিলিত হলেন। বনের মধ্যে পশু-পাখির ডাক শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, আমার মন ব্যাকুল হচ্ছে, আর শিকারের প্রয়োজন নেই। এই বলে তিনি ভাইদের সঙ্গে দ্রুতবেগে আশ্রমের দিকে চললেন। দ্রৌপদীর ধাত্রীকন্যা মাটিতে পড়ে কাঁদছে দেখে যুধিষ্ঠিরের সারথি ইন্দ্রসেন রথ থেকে লাফিয়ে নেমে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কাঁদছ কেন? দ্রৌপদীর কোনও বিপদ হয় নি তো? বালিকা তার চোখ মুছে বললো, জয়দ্রথ তাকে সবলে হরণ করে নিয়ে গেছে।
ধাত্রীকন্যার কথা শুনে যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুতবেগে দ্রৌপদীর অনুসরণে যাত্রা করলেন। কিছুদূর গিয়ে তারা দেখলেন, সৈন্যদের ঘোড়া চলার জন্য ধূলি উড়ছে আর শুনতে পেলেন ধৌম্য চীৎকার কোরে ভীমকে ডাকছেন। পাণ্ডবগণ ধৌম্যের কাছে গিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলেন এবং জয়দ্রথের রথে দ্রৌপদীকে দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। পাণ্ডবদের আসতে দেখেই দুরাত্মা জয়দ্রথের ভয় পেয়ে তার সঙ্গে রাজাদের বললেন, আপনারা পাণ্ডবদেরকে আক্রমণ করুন। তখন দুই পক্ষে ঘোর যুদ্ধ হতে লাগল, পাণ্ডবগণের প্রত্যেকেই জয়দ্রথের সঙ্গে থাকা বহু যোদ্ধাকে বধ করলেন। কোটিকাস্য ভীমের গদাঘাতে নিহত হলেন। স্বপক্ষের বীরগণকে মারা যেতে দেখে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে রথ থেকে নামিয়ে দিয়ে প্রাণরক্ষার জন্য বনের মধ্যে পালিয়ে গেলেন। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে নিজের রথে উঠিয়ে নিলেন। ভীম বললেন, দ্রৌপদী, নকুল, সহদেব আর ধৌম্যকে নিয়ে আপনি আশ্রমে ফিরে যান। পাষণ্ড জয়দ্রথ যদি পাতালেও গিয়ে থাকে তথাপি সে জীবিত অবস্থায় আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না।
যুধিষ্ঠির বললেন, জয়দ্রথ দুরাত্মা হলেও দুঃশলা ও গান্ধারীর কথা ভেবে তাকে বধ করা উচিত নয়। দ্রৌপদী রেগে গিয়ে বললেন, যদি আমার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া কর্তব্য মনে করো তবে সেই নরাধম পাপী কুলাঙ্গারকে বধ করতেই হবে। যে শত্রু পত্নী বা রাজ্য হরণ করে তাকে কখনও মুক্তি দেওয়া উচিত নয়। তখন ভীম আর অর্জুন জয়দ্রথের সন্ধানে গেলেন। যুধিষ্ঠির আশ্রমে এসে দেখলেন, সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে আর মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি ঋষিগণ সেখানে সমবেত হয়েছেন।
জয়দ্রথকে ধরবার জন্য ভীম ও অর্জুন দ্রুতবেগে রথ চালালেন। অর্জুনের বাণের আঘাতে জয়দ্রথের রথের ঘোড়াগুলি বিনষ্ট হওয়ায় তিনি রথ থেকে নেমে পালাবার চেষ্টা করলে অর্জুন তাকে বললেন, জয়দ্রথ, তুমি এই বিক্রম নিয়ে দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়েছিলে! এখন অনুচরদের শত্রুর হাতে ফেলে পালাচ্ছ কেন? জয়দ্রথ থামলেন না, ভীম দাঁড়াও দাঁড়াও বলে তার পিছনে ছুটলেন। অর্জুন ভীমকে বললেন, ওকে বধ করবেন না।
ভীম দ্রুতবেগে গিয়ে জয়দ্রথের চুল ধরলেন এবং তাকে মাটিতে ফেলে দেলেন। তারপর জয়দ্রথের মাথায় লাথি মেরে তাকে পা দিয়ে চেপে ধরে প্রচণ্ড মারতে লাগলেন। ভীমের হাতে মার খেয়ে জয়দ্রথ অচেতন হলেন। তাকে বধ করতে যুধিষ্ঠির বারণ করেছেন এই কথা অর্জুন মনে করিয়ে দিলে ভীম বললেন, এই পাপী দ্রৌপদীকে কষ্ট দিয়েছে, এ বাঁচবার যোগ্য নয়। কিন্তু আমি কি করবো, যুধিষ্ঠির হচ্ছেন দয়ালু, আর তুমি তার কথা শুনে সব সময় আমাকে বাধা দাও। এই কথা বলে ভীম জয়দ্রথের মাথার কয়েক জায়গায় চুল মুড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি জয়দ্রথকে বললেন, যদি বাঁচতে চাও তবে সবাইকে এই কথা বলবে যে তুমি আমাদের দাস। এই প্রতিজ্ঞা করলে তোমাকে প্রাণদান করবো। জয়দ্রথ বললেন, তাই হবে। তখন ভীম জয়দ্রথকে বেঁধে রথে উঠিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে এলেন। যুধিষ্ঠির একটু হেসে বললেন, এঁকে ছেড়ে দাও। ভীম বললেন, আপনি দ্রৌপদীকে বলুন, এই পাপাত্মা এখন পাণ্ডবদের দাস। যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, তুমি এর মাথায় কয়েক জায়গায় চুল মুড়িয়ে দিয়েছ, এ এখন আমাদের দাস হয়েছে, এখন একে মুক্তি দাও। জয়দ্রথ মুক্তি পেয়ে যুধিষ্ঠির ও উপস্থিত মুনিগণকে বন্দনা করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, নরাধম, তুমি দাসত্ব থেকে মুক্ত হলে, আর এমন কুকাজ করো না।
লজ্জিত ও লাঞ্ছিত জয়দ্রথ গঙ্গাতীরে গিয়ে মহাদেবের শরণাপন্ন হয়ে কঠোর তপস্যা করলেন। মহাদেব বর দিতে এলে জয়দ্রথ বললেন, আমি যেন পঞ্চপাণ্ডবকে যুদ্ধে জয় করতে পারি। মহাদেব বললেন, তা হবে না। অর্জুন ভিন্ন অপর পাণ্ডবগণকে কেবল এক দিনের জন্য তুমি জয় করতে পারবে। এই বলে তিনি চলে গেলেন।
______________
(ক্রমশ)