Storey of Mahabharat Part 35 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 35

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 35

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩৫

যুধিষ্ঠির ও শকুনির পাশা খেলা

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

যুধিষ্ঠির ও শকুনির পাশা খেলা

পাণ্ডবগণ পাশা খেলার সভায় প্রবেশ করার পর শকুনি বললেন, রাজা যুধিষ্ঠির, সভায় সকলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন, এখন খেলা আরম্ভ হোক। যুধিষ্ঠির বললেন, পাশা খেলা কপটতাময় ও পাপজনক, তাতে ক্ষত্রিয়ের পরাক্রম নেই, নীতিসংগতও নয়। কপটতায় গৌরব নেই, শকুনি, আশা করি আপনি অন্যায়ভাবে পাশা খেলায় জয়লাভ করবেন না। শকুনি বললেন, যে আগেই জানে পাশার গুঁটি ফেললে কোন্ সংখ্যা পড়বে, যে কপটতার পদ্ধতি বোঝে এবং যে পাশা খেলায় দক্ষ সে জয় বা পরাজয় দুই-ই মানতে পারে। যুধিষ্ঠির, দক্ষ খেলোয়াড়ের কাছে বিপক্ষের পরাজয় হয়, সে কারণে আমারই পরাজয়ের আশঙ্কা আছে, তবুও আমরা খেলবো। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি কপটতার দ্বারা সুখ বা ধন লাভ করতে চাই না, ধূর্ত খেলোয়াড়ের কপটতা প্রশংসনীয় নয়। শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও বিদ্বানরাও কপটতার দ্বারা পরস্পরকে জয় করতে চেষ্টা করেন, এমন কপটতা নিন্দনীয় নয়। তবে তোমার যদি আপত্তি বা ভয় থাকে তবে, খেলো না। যুধিষ্ঠির বললেন, আহ্বান করলে আমি পিছিয়ে যাই না। এই সভায় কার সঙ্গে আমার খেলা হবে? পণ কে দেবে? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, মহারাজ, আমিই পণের জন্য ধনরত্ন দেব আর আমার মামা শকুনি আমার পক্ষ থেকে খেলবেন। যুধিষ্ঠির বললেন, একজনের পরিবর্তে অন্যের খেলা রীতিবিরুদ্ধ। যাই হোক, যা ভাল বোঝ তাই করো।

এই সময়ে ধৃতরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গে অপ্রসন্ন মনে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, ও বিদুর সভায় এসে আসন গ্রহণ করলেন। তার পর খেলা আরম্ভ হল। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা দুর্যোধন, সাগরের ঢেউ থেকে উৎপন্ন আমার স্বর্ণহারের মহামূল্য মণি আমার বাজী। তোমার বাজী কি? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, আমার অনেক মণি আর ধন আছে, সে সমস্তই আমার বাজী। তখন শকুনি তার পাশা ফেললেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই জিতলাম।

যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনি, আপনি কপট খেলায় আমার বাজী জিতে নিলেন। তার পর শকুনি একের পর এক কপট পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরের সমস্ত সম্পদ, রাজ্য, সমস্ত গবাদি পশু, ঘোড়া, হাতি, শস্যভাণ্ডার, রথ, দাস-দাসী, সেনাবাহিনী সবকিছু শকুনি কপট পাশা খেলায় জয় করলেন।

পাশা খেলায় এইরূপে যুধিষ্ঠিরের সর্বনাশ হচ্ছে দেখে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, মুমূর্ষ ব্যক্তির যেমন ঔষধে রুচি হয় না, তেমন আমার কথাও হয়তো আপনার ভালো লাগবে না, তবুও বলছি শুনুন, এই দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করেই শিয়ালের ন্যায় আওয়াজ করেছিল, এ ভরতবংশ ধ্বংস করবে। আপনি জানেন যে অন্ধক, যাদব আর ভোজবংশীয়গণ তাদেরই আত্মীয় কংসকে ত্যাগ করেছিলেন এবং তাদেরই অনুরোধে কৃষ্ণ কংসকে বধ করেছিলেন। আপনি আদেশ দিন, অর্জুন দুর্যোধনকে বধ করবেন, এই পাপী নিহত হলে কৌরবগণ সুখী হবে। আপনি শিয়ালের তুল্য দুর্যোধনের বিনিময়ে পাণ্ডবগণকে সন্তুষ্ট করুন। বংশরক্ষার প্রয়োজনে যদি একজনকে ত্যাগ করতে হয় তবে তাই করা উচিত, গ্রামরক্ষার জন্য কুল, জনপদ রক্ষার জন্য গ্রাম এবং আত্মরক্ষার জন্য পৃথিবীও ত্যাগ করা উচিত। পাশা খেলা থেকে কলহ, বিভেদ ও দারুণ শত্রুতা হয়, দুর্যোধন তাই সৃষ্টি করছে। মহারাজ, দুর্যোধনের জয়ে আপনার খুব আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু এ থেকেই যুদ্ধ আর লোকক্ষয় হবে। ধনের প্রতি আপনার আকর্ষণ আছে এবং তার জন্য আপনি মন্ত্রণা করেছেন তা জানি। এখন আপনার ভ্রাতুস্পুত্র যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এই যে বিবাদ সৃষ্টি হোলো, এতে আমাদের সম্মতি নেই। হে শান্তনুর বংশধরগণ, তোমরা আমার কথা শোন, ভয়ঙ্কর আগুন প্রজ্বলিত হয়েছে, নির্বোধের মতো তাতে প্রবেশ করো না। এই অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, ও সহদেব যখন ক্রোধ সংবরণ করতে পারবেন না তখন তুমুল যুদ্ধ সব ধ্বংস হোয়ে যাবে। এই কপট শকুনি যেখান থেকে এসেছে সেখানে চলে যাক, পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ করো না।

দুর্যোধন বিদুরকে বললেন, আপনি সব সময় আমাদের নিন্দা আর মূর্খ ভেবে অবজ্ঞা করেন। আপনি নির্লজ্জ, তাই যা ইচ্ছা তাই বলছেন। আমার কিসে কল্যাণ হবে তা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি না। আপনি আমাদের বিরক্ত করবেন না। যে লোক শত্রুর দলভুক্ত, তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিৎ। অতএব, আপনি যেখানে ইচ্ছা চলে যান।

বিদূর বললেন, দুর্যোধন, ষাট বৎসরের পতি যেমন কোনো কুমারীর কাম্য নয়, আমিও সেইরূপ তোমার অপ্রিয়। এর পরে যদি সকল বিষয়ে নিজের পছন্দ মতো মন্ত্রণা চাও, তবে স্ত্রীলোক, জড়বুদ্ধি, পঙ্গু ও মূর্খদের জিজ্ঞাসা করো। পছন্দ মতো মন্ত্রণা দেওয়ার মতো মিষ্টভাষী পাপী লোক অনেক আছে কিন্তু অপ্রিয় হিতকথা বলার মতো বক্তা আর শ্রোতা দুইই দুর্লভ।

শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি পাণ্ডবদের সমস্ত সম্পত্তি হেরেছ, আর যদি কিছু থাকে তো বলো। তখন যুধিষ্ঠির একে একে তার চার ভাই এবং শেষে নিজেকেই বাজী রাখলেন এবং হারলেন।

শকুনি বললেন, রাজা, কিছু ধন অবশিষ্ট থাকতে তুমি নিজেকে পণ রেখে হারলে, এতে পাপ হয়। তোমার প্রিয়া পাঞ্চালী এখনও বিজিত হননি, তাকে পণ রেখে নিজেকে মুক্ত কর। শকুনির কথা শুনে যুধিষ্ঠির তখন দ্রৌপদীকেও বাজী রাখলেন।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদীকেও বাজী রাখতে দেখে সভায উপস্থিত সকল সজ্জন ব্যক্তিরা ক্ষুব্ধ হোলো, প্রবীণেরা সকলে ধিক ধিক বললেন, ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর মাথায় হাত দিয়ে মুখ নিচু কোরে বসে রইলেন। ধৃতরাষ্ট্র নিজের মনোভাব গোপন করতে পারলেন না, খুশি হয়ে বার বার জিজ্ঞাসা করলেন, কি জিতলে, কি জিতলে? কর্ণ, দুঃশাসন প্রভৃতি আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, দ্রৌপদীকে জিতেছি।

দ্রৌপদীকে জিতে নেওয়ার পর দুর্যোধন বিদুরকে বললেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে আসুন, সে অন্য দাসীদের সঙ্গে পরিচারিকার কাজ করুক। বিদুর বললেন, তোমার মতন দুষ্ট লোকেই এমন কথা বলতে পারে। দ্রৌপদী দাসী হোতে পারেন না, কারণ তাঁকে বাজী রাখবার সময় যুধিষ্ঠিরের তার উপর কোনো অধিকার ছিলো না।

______________

(ক্রমশ)