মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩০
রাজসূয় যজ্ঞের বিষয়ে কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদির মন্ত্রণা
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
রাজসূয় যজ্ঞের বিষয়ে কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদির মন্ত্রণা
নারদের উপদেশ শুনে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করার বিষয়ে বার বার ভাবতে লাগলেন। তিনি ক্রোধ ও অহঙ্কার ত্যাগ কোরে কেবল ধর্ম ও বিধি মতে কোনো রকম পক্ষপাত না কোরে সকলের মঙ্গল করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। প্রজারা যুধিষ্ঠিরকে পিতার তুল্য মনে করত, তার কোনো শত্রু ছিলো না এজন্য তিনি অজাতশত্রু নামে খ্যাত হলেন। তিনি ভাইদের উপর বিভিন্ন কাজের ভার দিয়ে তাদের সাহায্যে রাজ্য শাসন ও পালন করতে লাগলেন। তার রাজত্বকালে তেজারতি, যজ্ঞকার্য, গোরক্ষা, কৃষি ও বাণিজ্যের সবিশেষ উন্নতি হোলো। রাজকরের অনাদায়, করের জন্য প্রজাপীড়ন, ব্যাধি ইত্যাদির ভয় ছিল না, রাজকর্মচারীদের মিথ্যাচার শোনা যেত না।
যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ সম্বন্ধে তার মন্ত্রী ও ভাইদের মত জিজ্ঞাসা করলে তারা বললেন, আপনি সম্রাট হবার যোগ্য, আপনার সুহৃদগণ মনে করেন যে এখনই রাজসূয় যজ্ঞ করবার উপয়ুক্ত সময়। পুরোহিত ও মুনিগণও এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। এই বিষয়ে কৃষ্ণের মত জানা কর্তব্য ভেবে যুধিষ্ঠির একজন দূতকে দ্রুতগামী রথে দ্বারকায় পাঠালেন এবং কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা জেনে সত্বর ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন।
কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, রাজসূয় যজ্ঞ করবার সকল গুণই আপনার আছে, তবুও কিছু বলছি শুনুন। সমস্ত পৃথিবী যাঁর বশে থাকে তিনিই সম্রাটের পদ লাভ করেন। পৃথিবীতে এখন যে সকল রাজা বা ক্ষত্রিয় আছেন তারা সকলেই পুরূরবা বা ইক্ষাকুর বংশধর। যযাতির বংশজ ভোজবংশীয়গণ চতুর্দিকে রাজত্ব করছেন, কিন্তু তাদের সকলকে পরাজিত ও অধিন কোরে জরাসন্ধ এখন শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন।
প্রতাপশালী শিশুপাল সেই জরাসন্ধের সেনাপতি। মহাবল রাজা বক্র, করভ, মেঘবাহন প্রভৃতি রাজা, এবং আপনার পিতার বন্ধু মুর ও নরক দেশের অধিপতি বুদ্ধ, যবনরাজ ভগদত্ত, এঁরা সকলেই জরাসন্ধের অনুগত। কেবল আপনার মামা পুরুজিৎ, যিনি পশ্চিম ও দক্ষিণ দেশের রাজা, স্নেহবশে আপনার পক্ষে আছেন। যে দুর্মতি নিজেকে বাসুদেব বলে প্রচার করে এবং আমার চিহ্ন ধারণ করে, সেই রাজা পৌণ্ড্রকও জরাসন্ধের পক্ষে আছে। ভোজবংশজ মহাবল ভীষ্মকের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা আছে, আমরা সর্বদা তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখি, তথাপি তিনি জরাসন্ধের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। বহু দেশের রাজারা জরাসন্ধের ভয়ে নিজ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। দুর্মতি কংস জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তিকে বিবাহ করে শ্বশুরের সহায়তায় নিজের জ্ঞাতিদের উপর অত্যাচার করেছিল, সেজন্য বলরাম ও আমি কংসকে বধ করি। তারপর আমরা আত্মীয়দের সঙ্গে মন্ত্রণা করে এই সিদ্ধান্তে এলাম যে তিন শ বছর লাগাতার যুদ্ধ করেও আমরা জরাসন্ধের সেনা সংহার করতে পারবো না।
হংস ও ডিম্ভক নামে দুই মহাবল রাজা জরাসন্ধের সহায় ছিলেন। বহু বার যুদ্ধ করবার পর বলরাম হংসকে বধ করেন, সেই সংবাদ শুনে মনের দুঃখে ডিম্ভকও জল ডুবে প্রাণত্যাগ করেন। জরাসন্ধ তখন তার সৈন্যদল নিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যান, আমরাও আনন্দিত হয়ে মথুরায় বাস করতে লাগলাম। তারপর কংসের পত্নী অস্তি তার পিতা জরাসন্ধের কাছে গিয়ে বার বার বললেন, আমার পতিহন্তাকে বধ করুন। তখন আমরা ভয় পেয়ে জ্ঞাতি ও বন্ধুদের সঙ্গে পশ্চিম দিকে পালিয়ে গেলাম এবং রৈবতক পর্বতের কুশস্থলীতে দুৰ্গসংস্কার করে সেখানেই আশ্রয় নিলাম। সেই দুর্গম স্থানে দেবতারাও আসতে পারেন না এবং স্ত্রীলোকেও তা রক্ষা করতে পারে। রৈবতক পর্বত তিন যোজন দীর্ঘ এবং এক যোজন বিস্তৃত। আমাদের গিরিদুর্গে শত শত দ্বার আছে, আঠার জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তার প্রত্যেকটি রক্ষা করে। আমাদের বংশে আঠার হাজার ভ্রাতা আছেন। চারুদেষ্ণ, চক্রদেব ও তার ভাই, সাত্যকি, আমি, বলরাম এবং শাম্ব —আমরা এই সপ্ত রথী যুদ্ধে বিষ্ণুর তুল্য। এ ছাড়া কৃতবর্মা, অনাবৃষ্টি, কঙ্ক, বৃদ্ধ অন্ধকভোজ রাজা এবং তার দুই পুত্র প্রভৃতি যোদ্ধারা আছেন। এঁরা সকলেই এখন বৃষ্ণিগণের সঙ্গে বাস করছেন এবং পূর্ব বাসভূমি মথুরার কথা ভাবছেন। হে মহারাজ, জরাসন্ধ জীবিত থাকতে আপনি রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবেন না। তিনি মহাদেবের বরপ্রভাবে ছিয়াশি জন রাজাকে জয় করে তার রাজধানী গিরিব্রজে বন্দী করে রেখেছেন, আরও চোদ্দ জনকে পেলেই তিনি সকলকে বলি দেবেন। যদি আপনি যজ্ঞ করতে চান তবে সেই রাজাদের মুক্ত করার এবং জরাসন্ধকে বধ করবার চেষ্টা করুন।
ভীম বললেন, কৃষ্ণ, অর্জুন আর আমি তিন জনে মিলে জরাসন্ধকে জয় করতে পারি। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম ও অর্জুন আমার দুই চোখ এবং কৃষ্ণ আমার মন। তোমাদের বিসর্জন দিয়ে আমি কি করে জীবন ধারণ করবো? স্বয়ং যমরাজও জরাসন্ধকে জয় করতে পারেন না। অতএব রাজসূয় যজ্ঞের সংকল্প ত্যাগ করাই উচিৎ বলে মনে করি।
অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমি দুর্লভ ধনু, শর, উৎসাহ, সহায় ও শক্তির অধিকারী, বলপ্রয়োগ করাই আমি উচিত মনে করি। যদি আপনি যজ্ঞের সংকল্প ত্যাগ করেন তবে আপনার গুণহীনতাই প্রকাশ পাবে। যদি শান্তিকামী মুনি হোতে চান তবে এর পর গৈরিক বস্ত্র ধারণ করবেন, কিন্তু এখন সাম্রাজ্যলাভ করুন, আমরা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করবো।
কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন ভরতবংশের যোগ্য কথা বলেছেন। যুদ্ধ না করে কেউ অমর হয়েছে এমন আমরা শুনি নি। বুদ্ধিমানের নীতি এই, যে অতি প্রবল শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করবে না। জরাসন্ধ সম্বন্ধে আমার তাই মত। আমরা ছদ্মবেশে শত্রুগৃহে প্রবেশ করবো এবং তাকে একাকী পেলেই উদ্দেশ্য পূরণ করবো। আমাদের আত্মীয় রাজাদের মুক্তির জন্য আমরা জরাসন্ধকে বধ করতে চাই, তার জন্য যদি মরি তবে আমাদের স্বর্গলাভ হবে।
যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, এই জরাসন্ধ কে? তার কি এমন পরাক্রম যে অগ্নিতুল্য তোমাকেও স্পর্শ করে পতঙ্গের ন্যায় পুড়ে মরে নি? কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, জরাসন্ধ কে এবং আমরা কেন তার বহু উৎপীড়ন সহ্য করেছি তা বলছি শুনুন –
“বৃহদ্রথ নামে মগধদেশে এক রাজা ছিলেন, তিনি তিন অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি। কাশীরাজের দুই যমজ কন্যাকে তিনি বিবাহ করেন। বৃহদ্রথ তার দুই ভার্যাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দুজনকেই সমদৃষ্টিতে দেখবেন। রাজার যৌবন গত হোলো কিন্তু তিনি পুত্রলাভ করলেন না। একদিন চণ্ডকৌশিক মুনি রাজাকে একটি মন্ত্রসিদ্ধ আম দেন, সেই আম দুই ভাগ কোরে দুই পত্নী খেলেন এবং গর্ভবতী হয়ে দশম মাসে দুজনে দুই শরীরখণ্ড প্রসব করলেন। তারা জীবন্ত হোলেও প্রত্যেকটির এক চক্ষু, এক বাহু, এক পদ এবং অর্ধেক মুখ ও পেট। রাণীরা ভয়ে ও দুঃখে তাদের সন্তান পরিত্যাগ করলে দুজন ধাত্রী সেই দুই জীবন্ত শরীরখণ্ড ঢেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলো। সেই সময়ে জরা নামে এক রাক্ষসী সেখানে এল এবং খণ্ড দুটিকে দেখে সুদৃশ্য করবার ইচ্ছায় সংযুক্ত করলো। তৎক্ষণাৎ একটি পূর্ণাঙ্গ বীর কুমার উৎপন্ন হল। রাক্ষসী বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করে দেখতে লাগল, বজ্রতুল্য ভারী সেই শিশুকে সে তুলতে পারল না। শিশুটি তার তাম্রবর্ণ হাতের মুঠি মুখে পুরে মেঘের আওয়াজের মতো গর্জন করে কাঁদতে লাগলো। সেই শব্দ শুনে রাজা, তার দুই পত্নী, এবং অন্তঃপুরের অন্যান্য লোক সেখানে এলেন। জরা রাক্ষসী নারীমূর্তি ধারণ করে শিশুটিকে কোলে নিয়ে বললো, বৃহদ্রথ, তোমার পুত্রকে নাও, ধাত্রীরা একে ত্যাগ করেছিল, আমি রক্ষা করেছি। তখন দুই কাশীরাজকন্যা বালককে কোলে নিয়ে স্তনদুগ্ধধারায় স্নান করালেন।
রাজা বৃহদ্রথ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? রাক্ষসী উত্তর দিলো, আমি জরা রাক্ষসী, তোমার গৃহে আমি সুখে বাস করছি। গৃহদেবী নামে রাক্ষসী প্রত্যেক মানুষের গৃহে বাস করে, দানব বিনাশের জন্য ব্রহ্মা তাদের সৃষ্টি করেছেন। যে লোক ভক্তি করে গৃহদেবীকে ঘরের দেওয়ালে চিত্রিত করে রাখে তার শ্রীবৃদ্ধি হয়। মহারাজ, আমি তোমার গৃহপ্রাচীরে চিত্রিত থেকে গন্ধ পুষ্প ভোজ্যাদির দ্বারা পূজিত হচ্ছি, সেজন্য তোমার উপকার করতে চাই। এই বলে রাক্ষসী চলে গেলো। জরা রাক্ষসী সেই কুমারকে জুড়ে দিয়েছিল, সেজন্য তার নাম জরাসন্ধ হল। যথাকালে জরাসন্ধকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করে বৃহদ্রথ তার দুই পত্নীর সঙ্গে তপোবনে চলে গেলেন। চণ্ডকৌশিকের আশীর্বাদে জরাসন্ধ সকল রাজার উপর প্রভুত্ব এবং ত্রিপুরারি মহাদেবকে সাক্ষাৎ দর্শনের শক্তি লাভ করলেন। পরবর্তী কালে কংস, হংস ও ডিম্ভকের মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে জরাসন্ধের প্রবল শত্রুতা হোলো।”
______________
(ক্রমশ)