মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২৩
পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ
পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীকে অনুসরণ কোরে ধৃষ্টদ্যুম্ন লুকিয়ে থেকে পাণ্ডব ভাইদের কথাবার্তা শুনে তিনি দ্রুপদকে সকল বৃত্তান্ত জানাবার জন্য দ্রুত পাঞ্চাল রাজভবনে ফিরে গেলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন যা দেখেছিলেন আর শুনেছিলেন সমস্তই দ্রুপদকে জানিয়ে বললেন, আমার মনে হয় তারা নিশ্চয় ক্ষত্রিয়। আমাদের আশা পূর্ণ হয়েছে, কারণ, শুনেছি পাণ্ডবরা জতুগৃহের অগ্নিদাহ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দ্রুপদ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তার পুরোহিতকে পাণ্ডবদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। পুরোহিত গিয়ে বললেন, দ্রুপদের ইচ্ছা তার কন্যা দ্রৌপদীকে অর্জুন ধর্মানুসারে বিবাহ করুন।
যুধিষ্ঠির বললেন, পাঞ্চালরাজ তার কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে জাতি কুল শীল গোত্র কিছুই নির্দেশ করেন নি। তার শর্ত অনুসারে আমার ভাই লক্ষ্যভেদ করে কৃষ্ণাকে জয় করেছেন, তার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। এমন সময় দ্রুপদের একজন দূত এসে বললো, রাজা দ্রুপদ তার কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে বরপক্ষের লোকজনকে ভোজন করাতে চান। সকলের জন্য উত্তম খাদ্য প্রস্তুত, সঙ্গে রথও এনেছি, আপনারা কৃষ্ণাকে নিয়ে শীঘ্র চলুন।
পুরোহিতকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে পাণ্ডবগণ, কুন্তী ও দ্রৌপদী পাঞ্চাল-রাজভবনে এলেন। বরপক্ষের জাতি পরীক্ষার জন্য দ্রুপদ বিভিন্ন উপহার আলাদা আলাদা ভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন, যথা — এক জায়গায় ফল ও মালা, এক জায়গায় নানা প্রকার অস্ত্র-শস্ত্র, এক জায়গায় গরু, শস্য, বীজ প্রভৃতি, আর এক জায়গায় বিবিধ শিল্পকার্যের যন্ত্র এবং খেলাধূলার উপকরণ। দ্রৌপদীকে নিয়ে কুন্তী অন্দরে গেলেন। পাণ্ডবগণ শ্রেষ্ঠ আসনে এসে বসলেন, রাজার ঐশ্বর্য দেখে তারা বিস্মিত হোলেন না। দাসদাসী ও পাচকগণ, সোনা ও রূপোর পাত্রে নানা প্রকার সুখাদ্য পরিবেশন করলো এবং পাণ্ডবগণ ভোজন করে তৃপ্ত হলেন। তার পর তারা সব রকমের উপহার উপেক্ষা কোরে যেখানে যুদ্ধের উপকরণ ছিল সেখানে গেলেন। তা লক্ষ্য করে দ্রুপদ রাজা, তার পুত্র ও মন্ত্রিগণ নিঃসন্দেহ হলেন যে এঁরাই পঞ্চপাণ্ডব।
যুধিষ্ঠির নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, মহারাজ, নিশ্চিন্ত হন, আমরা ক্ষত্রিয়, তাই আপনার কন্যা এক রাজগৃহ থেকে অন্য রাজগৃহে গেছেন। দ্রুপদ বললেন, আজ শুভদিন, তাই অর্জুন আজই যথাবিধি আমার কন্যাকে বিবাহ করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, আমাকেও বিবাহ করতে হবে। দ্রুপদ বললেন, তবে আমার কন্যাকে তুমিই বিবাহ করো, অথবা অন্য কাউকে উপযুক্ত মনে করলে তা বলো। তখন যুধিষ্ঠির বললেন, দ্রৌপদী আমাদের সকলের স্ত্রী হবেন, এই কথা আমার মাতা বলেছেন। দ্রুপদ বললেন, কুরুনন্দন, এক পুরুষের বহু স্ত্রী হতে পারে, কিন্তু এক স্ত্রীর বহু পতি শোনা যায় না। তুমি ধর্মজ্ঞ ও পবিত্রস্বভাব, এমন ধর্মবিরুদ্ধ কাজে তোমার মতি হল কেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, ধর্ম অতি সূক্ষ্ম, তার আমরা তা সম্পূর্ণ বুঝতে পারিনা, তাই প্রাচীনদের পথই আমরা অনুসরণ করি। আমি অসত্য বলি না, আমার মা যা বলেছেন তাই আমার ইচ্ছা।
দ্রুপদ, যুধিষ্ঠির, কুন্তী, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি সকলে মিলে বিবাহ সম্বন্ধে বিতর্ক করতে লাগলেন, এমন সময় বেদব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন। সকল বৃত্তান্ত তাকে জানিয়ে দ্রুপদ বললেন, আমার মতে এক স্ত্রীর বহু পতি হওয়া ধর্মবিরুদ্ধ। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, সদাচারী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কি করে কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবেন? যুধিষ্ঠির বললেন, পুরাণে শুনেছি গৌতমবংশের জটিলা সাতজন ঋষির পত্নী ছিলেন; মুনিকন্যা বাক্ষরির দশজন পতি ছিল, তাদের সকলেরই নাম প্রচেতা। মা সকল গুরুর শ্রেষ্ঠ, তাই তিনি যখন বলেছেন তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর, তখন তার আজ্ঞা পালন করাই ধর্ম। কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠিরের কথা সত্য। বেদব্যাস বললেন, পাঞ্চালরাজ, যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তাই সনাতন ধর্ম, যদিও সকলের পক্ষে নয়। এই বলে বেদব্যাস দ্রুপদের হাত ধরে অন্য এক গৃহে গেলেন।
বেদব্যাস দ্রুপদকে একটি প্রাচীন কাহিনি বললেন। “অনেক দিন আগে দেবতারা নৈমিষারণ্যে এক যজ্ঞ করেন, যম তার পুরোহিত ছিলেন। যম যজ্ঞে নিযুক্ত থাকায় মানুষের মৃত্যু বন্ধ হোয়ে মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল। দেবতারা উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি আশ্বাস দিলেন, যজ্ঞ শেষ হলে আবার মানুষের মৃত্যু হবে। দেবতারা যজ্ঞস্থানে যাত্রা করলেন। যেতে যেতে তারা গঙ্গার জলে একটি স্বর্ণপদ্ম দেখতে পেলেন। ইন্দ্র সেই পদ্ম নিতে গিয়ে দেখলেন, একজন অত্যন্ত সুন্দরী রমণী গঙ্গার গভীর জলে নেমে কাঁদছেন আর তার অশ্রুবিন্দু স্বর্ণপদ্ম হয়ে জলে পড়ছে। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, রমণী ইন্দ্রকে বললেন, আমার সঙ্গে আসুন। কিছুদূর গিয়ে ইন্দ্র দেখলেন, হিমালয় শিখরে সিদ্ধাসনে বসে এক সুদর্শন যুবা এক যুবতীর সঙ্গে পাশা খেলছেন। তারা খেলায় মত্ত হয়ে তাকে গ্রাহ্য করছেন না দেখে দেবরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এই বিশ্ব আমারই অধীন জেনো, আমিই এর ঈশ্বর। যুবা হাস্য করে ইন্দ্রের দিকে চাইলেন, ইন্দ্র স্থাণুর ন্যায় নিশ্চল হয়ে গেলেন। পাশা খেলা শেষ হলে সেই যুবা ইন্দ্রের সঙ্গিনীকে বললেন, ওকে নিয়ে এস, আমি ওর দর্প দূর করছি। সেই রমণীর স্পর্শমাত্র ইন্দ্র অবশ হয়ে ভূপতিত হলেন। তখন যুবারূপী মহাদেব বললেন, ইন্দ্র, আর কখনও অহঙ্কার করোনা। তুমি তো অসীম বলশালী, ওই পর্বতটি উঠিয়ে গহ্বরের ভিতরে গিয়ে দেখ। ইন্দ্র গহ্বরে প্রবেশ করে দেখলেন, তার তুল্য তেজস্বী চার জন পুরুষ সেখানে রয়েছেন। ইন্দ্রকে ভীত দেখে মহাদেব বললেন, গর্বের ফলে এরা এই গহ্বরে রয়েছে, তুমিও এখানে থাকো। তোমরা সকলেই মনুষ্য হয়ে জন্মাবে এবং বহু শত্রু বধ করে আবার ইন্দ্রলোকে ফিরে আসবে।
তখন পূর্ববর্তী চার ইন্দ্র বললেন, ধর্ম বায়ু ইন্দ্র ও অশ্বিনীদ্বয় আমাদের মানুষীর গর্ভে জন্ম দেবেন। বর্তমান ইন্দ্র বললেন, আমি নিজ বীর্যে একজন পুরুষ সৃষ্টি করে তাকেই পঞ্চম ইন্দ্ররূপে পাঠাব। মহাদেব তাতে রাজী হোলেন এবং সেই সুন্দরী রমণীকে মনুষ্যলোকে তাদের স্ত্রী হবার জন্য আদেশ দিলেন। এই সময়ে নারায়ণ তার একটি কালো এবং একটি সাদা চুল উৎপাটন করলেন। সেই দুই চুল যদুকুলে গিয়ে দেবকী ও রোহিণীর গর্ভে প্রবেশ করলো। সাদা চুল থেকে বলরাম এবং কালো চুল থেকে কৃষ্ণ জন্ম নিলেন।
এই কাহিনি শেষ করে বেদব্যাস দ্রুপদকে বললেন, মহারাজ, সেই পাঁচ ইন্দ্রই পাণ্ডবরূপে জন্মেছেন এবং তাদের স্ত্রীরূপে সেই সুন্দরী রমণীই দ্রৌপদী হয়েছেন। আমি আপনাকে দিব্য চক্ষু দিচ্ছি, পাণ্ডবদের পূর্বমূর্তি দেখুন। দ্রুপদ দেখলেন, তারা আগুন ও সূর্যতুল্য দিব্যরূপধারী এবং দেবতার সর্বলক্ষণ তাদের দেহে বর্তমান। দ্রুপদ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে বেদব্যাসকে প্রণাম করলেন। তখন বেদব্যাস এক ঋষিকন্যার কথা বললেন যাঁকে মহাদেব বর দিয়েছিলেন “তোমার পঞ্চপতি হবে”। বেদব্যাস আরও বললেন, মানুষের পক্ষে এরূপ বিবাহ বিহিত নয়, কিন্তু এঁরা দেবতার অবতার, মহাদেবের ইচ্ছায় দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী হবেন।
তার পর পঞ্চপাণ্ডব স্নান ও মাঙ্গলিক কার্য শেষ করে পুরোহিত ধৌম্যের সঙ্গে বিবাহ সভায় এলেন। যথানিয়মে অগ্নিতে আহুতি দেবার পর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বিবাহ করলেন। পরবর্তী চার দিনে একে একে অন্য ভাইদেরও বিবাহ সম্পন্ন হল। প্রত্যেক বার পুনর্বিবাহের পূর্বে ব্রহ্মর্ষি বেদব্যাস দ্রৌপদীকে এই অলৌকিক বাক্য বলতেন “তুমি আবার কুমারী হও”।
পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে বিবাহ হওয়ায় দ্রুপদ সমস্ত রকমের ভয় থেকে মুক্তিলাভ করলেন। কুন্তী তার পুত্রবধূকে আশীর্বাদ কোরে বললেন – “তুমি দীর্ঘজীবী হও, বীরপুত্রের জননী হও, বহু সুখ লাভ করো।
______________
(ক্রমশ)