Storey of Mahabharat Part 22 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 22

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 22

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২২

স্বয়ংবর শেষে কর্ণ, শল্য প্রভৃতির সঙ্গে ভীম ও অর্জুনের যুদ্ধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

স্বয়ংবর শেষে কর্ণ, শল্য প্রভৃতির সঙ্গে ভীম ও অর্জুনের যুদ্ধ

দ্রৌপদী স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত রাজা ও ব্রাহ্মণগণের সামনে অর্জুনের গলায় বরমাল্য পরানোর পরে অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর উপস্থিত রাজারা ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে লাগলেন, আমাদের মতো ক্ষত্রিয়দের পরিবর্তে পাঞ্চালরাজ একটা ব্রাহ্মণকে কন্যাদান করতে চান। আমরা দ্রুপদ আর তার পুত্রকে বধ করব। আমাদের ডেকে এনে উত্তম খাদ্য খাইয়ে পরিশেষে অপমান করা হয়েছে। স্বয়ংবর ক্ষত্রিয়ের জন্য, তাতে ব্রাহ্মণের অধিকার নেই। এই কন্যা আমাদের মধ্যে কাউকে বরণ না করলে, এই কন্যাকে আগুনে ফেলে আমরা চলে যাব। লোভের বশে যে আমাদের অপ্রিয় কাজ করেছে সেই ব্রাহ্মণকে আমরা বধ করতে পারি না, তাই দ্রুপদকেই বধ করব।

রাজারা সবাই একসঙ্গে মিলে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছেন দেখে দ্রুপদ শান্তির কামনায় ব্রাহ্মণদের শরণাপন্ন হলেন। তখন ভীম একটা গাছ উপড়ে নিয়ে অর্জুনের পাশে দাঁড়ালেন, অর্জুনও ধনুর্বাণ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলেন। ব্রাহ্মণরা হাত নেড়ে বললেন, ভয় পেয়ো না, আমরাও যুদ্ধ করব। অর্জুন সহাস্যে বললেন, আপনারা দর্শক হয়ে এক পাশে থাকুন, আমি এই রাজাদের একাই পরাস্ত করবো।

তারপর, সমস্ত রাজারা এবং কর্ণ ও দুর্যোধনাদি ব্রাহ্মণদের দিকে ধেয়ে গেলেন। কর্ণ অর্জুনকে এবং শল্য ভীমকে আক্রমণ করলেন। অর্জুনের আশ্চর্য তীরন্দাজী দেখে আশ্চর্য হোয়ে কর্ণ বললেন, ব্রাহ্মণ, তুমি কি রাম না বিষ্ণু? অর্জুন বললেন, আমি একজন ব্রাহ্মণ, গুরুর কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছি। এই বলে অর্জুন কর্ণের ধনু ছেদন করলেন। কর্ণ অন্য ধনু নিলেন, অর্জুন তাও ছেদন করলেন। নিজের সকল অস্ত্র বিফল হওয়ায় কর্ণ ভাবলেন, ব্রহ্মতেজ অজেয়, তখন তিনি বাইরে চলে গেলেন। শল্য আর ভীম বহুক্ষণ মুষ্টিযুদ্ধ করলেন। অবশেষে, ভীম শল্যকে তুলে ভূমিতে নিক্ষেপ করলেন। তাই দেখে ব্রাহ্মণরা হেসে উঠলেন। রাজারা বললেন, এই দুই যোদ্ধা ব্রাহ্মণ বিশেষ প্রশংসার পাত্র, আমাদের যুদ্ধ থেকে বিরত হওয়াই উচিত। এঁদের পরিচয় জানতে পারলে আবার যুদ্ধ করব। কৃষ্ণ সকলকে অনুনয় করে বললেন, এঁরা ধর্মানুসারেই দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন, আপনারা চলে যান। তখন রাজারা চলে গেলেন।

ভীম ও অর্জুন তাদের বাসস্থান কুম্ভকারের বাড়িতে এসে বাইরে থেকেই আনন্দিত মনে কুন্তীকে জানালেন যে, তারা ভিক্ষা এনেছেন। ঘরের ভিতর থেকে কুন্তী বললেন, তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর। তার পর দ্রৌপদীকে দেখে বললেন, আমি অন্যায় কথা বলে ফেলেছি। তিনি দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে বললেন, পুত্র, তোমরা দ্রুপদ রাজার এই কন্যাকে আমার কাছে এনেছো, আমি ভুল কোরে বলেছি - সকলে মিলে ভোগ কর। যাতে এঁর পাপ না হয় তার উপায় বলো। যুধিষ্ঠির একটু চিন্তা করে বললেন, অর্জুন, তুমি কৃষ্ণাকে জয় করেছো, তুমিই এঁকে যথাবিধি বিবাহ কর। অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমাকে অধৰ্ম  করতে বলবেন না, আগে আপনার, তার পর ভীমের, তার পর আমার, তারপর নকুল ও সহদেবের বিবাহ হবে। দ্রৌপদী সকলকেই দেখছিলেন, পাণ্ডবরাও পরস্পরের দিকে চেয়ে দ্রৌপদীর প্রতি আসক্ত হলেন। যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের মনোভাব বুঝলেন, তিনি ব্যাসের কথা স্মরণ করে এবং ভ্রাতাদের মধ্যে পাছে বিভেদ হয়, সেই ভয়ে বললেন, ইনি আমাদের সকলেরই স্ত্রী হবেন।

এমন সময় কৃষ্ণ ও বলরাম সেখানে এলেন এবং যুধিষ্ঠির ও পিসি কুন্তীকে বললেন, আমরা কৃষ্ণ ও বলরাম। কুশল প্রশ্নের পর যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা এখানে গোপনে বাস করছি, তোমরা জানলে কি করে ? কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, মহারাজ, আগুন গুপ্ত থাকলেও তার উত্তাপ প্রকাশ পায়, পাণ্ডব ভিন্ন অন্য কার এত বিক্রম? ভাগ্যক্রমে আপনারা জতুগৃহ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, ধৃতরাষ্ট্রের পাপী পুত্রদের মতলব সিদ্ধ হয়নি। আপনাদের উন্নতি হোক, আপনারা গোপনে থাকবেন। এই বলে কৃষ্ণ ও বলরাম প্রস্থান করলেন।

পাণ্ডবেরা যখন দ্রৌপদীকে নিজেদের আবাসে নিয়ে আসছিলেন, তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন গোপনে তাদের পিছনে আসছিলেন। কুম্ভকারের ঘরের চারদিকে নিজের অনুচরদের রেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন গোপনে লুকিয়ে রইলেন। সন্ধ্যাকালে কুন্তী ভিক্ষান্ন রান্না করে দ্রৌপদীকে বললেন, তুমি আগে দেবতা ব্রাহ্মণ আর আগন্তুকদের অন্ন দাও, তারপর যা থাকবে তার অর্ধেক ভীমকে দাও। অবশিষ্ট বাকি চার ভাই, তোমার আর আমার জন্য ভাগ কর। দ্রৌপদী খুশি হোয়ে কুন্তীর নির্দেশ পালন করলেন। ভোজনের পর সকলে শুয়ে পড়লেন। পাণ্ডবরা শুয়ে শুয়ে অস্ত্র, রথ, হস্তী প্রভৃতি সেনাবিষয়ক আলোচনা করতে লাগলেন। আড়াল থেকে ধৃষ্টদ্যুম্ন সমস্তই শুনলেন এবং বোনকে দেখলেন। তিনি রাত্রিকালেই দ্রুপদকে সকল বৃত্তান্ত জানাবার জন্য সত্বর চলে গেলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের কাছে সব শুনে বিষগ্ন দ্রুপদ পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, কৃষ্ণা কাকে বরমাল্য পরালো? কোনও হীনজাতি তাকে জয় কোরে নিয়ে যায় নি তো? অর্জুনই কি লক্ষ্যভেদ করেছেন? কৃষ্ণার জন্য আমার খুব দুশ্চিন্তা হোচ্ছে।

______________

(ক্রমশ)