Storey of Mahabharat Part 19 in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 19

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 19

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৯

ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর জন্ম এবং গন্ধর্বরাজ চিত্ররথের কাহিনি

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর জন্ম এবং গন্ধর্বরাজ চিত্ররথের কাহিনি

বক রাক্ষসকে ভীম বধ করবার কিছু দিন পরে পাণ্ডবদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে অন্য এক ব্রাহ্মণ অতিথি রূপে উপস্থিত হলেন। ইনি নানা দেশের বিবিধ ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জানতেন। সেই সব ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, পাঞ্চাল দেশের রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর হবে। পাণ্ডবগণ বিশদ ভাবে জানতে চাইলে তিনি এই বললেন যে, দ্রোণাচার্যের নিকট পরাজয়ের পর দ্রুপদ প্রতিশোধ ও পুত্রলাভের জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হলেন। তিনি গঙ্গা ও যমুনার তীরে চলতে চলতে একটি ব্রাহ্মণদের বসতিতে এলেন। সেখানে যাজ ও উপযাজ নামে দুই ব্রহ্মর্ষি বাস করতেন। উপযাজের পদসেবা করে দ্রুপদ বললেন, আমি আপনাকে দশ কোটি গরু দান করব, আপনি আমাকে এমন পুত্র পাইয়ে দিন যে দ্রোণকে বধ করবে। উপযাজ রাজি হোলেন না, তথাপি দ্রুপদ তাঁর সেবা করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে উপযাজ বললেন, আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যাজ শুচি অশুচি বিচার করেন না, আমি তাকে মাটিতে পড়ে থাকা ফল তুলে নিতে দেখেছি। ইনি গুরুগৃহে বাস করার সময় অন্যের উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন ভোজন করতেন। আমার মনে হয় যাজ ধন চান এবং আপনার জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবেন। যাজের প্রতি অশ্রদ্ধা হলেও দ্রুপদ তার কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানালেন। যাজ সম্মত হলেন এবং উপযাজকে সহায়রূপে নিযুক্ত করলেন।

যজ্ঞ শেষ হলে যাজ দ্রুপদের স্ত্রীকে ডেকে বললেন, এখানে আসুন, আপনার দুই সন্তান উপস্থিত হয়েছে। মহিষী বললেন, আমার মুখপ্রক্ষালন এবং স্নান হয়নি, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। যাজ বললেন, যজ্ঞাগ্নিতে আমি আহুতি দিচ্ছি, উপযাজ মন্ত্রপাঠ করছেন, আপনি আসুন বা না আসুন এখন ইচ্ছা পূর্ণ হবেই। যাজ আহুতি দিলে যজ্ঞাগ্নি থেকে এক অগ্নিবর্ণ বর্মমুকুটভূষিত খড়্গ ও ধনুর্বাণধারী কুমার সগর্জনে উঠে এলেন। পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হয়ে সাধু সাধু বলতে লাগল। এমন সময় আকাশবাণী হোলো —এই রাজপুত্র দ্রোণকে বধ করে রাজার শোক দূর করবেন। তারপর যজ্ঞবেদী থেকে কুমারী পাঞ্চালী উঠে এলেন। তিনি সুদর্শনা, শ্যামবর্ণা, পদ্মফুলের পাঁপড়ির মতো চোখ, কোঁকড়ানো কৃষ্ণকেশ এবং তাঁর অঙ্গসৌরভ বহু দূরেও অনুভূত হয়। আকাশবাণী হল - সমস্ত নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণা হতে ক্ষত্রিয়ক্ষয় এবং কুরুবংশের সর্বনাশ হবে। দ্রুপদ ও তার স্ত্রী এই কুমার ও কুমারীকে পুত্র-কন্যা রূপে লাভ করে অতিশয় সন্তুষ্ট হলেন। কুমারের নামকরণ করা হোলো ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শ্যামবর্ণের জন্য এবং আকাশবাণী অনুসারে কুমারীর নামকরণ হোলো কৃষ্ণা। দেবতার নির্বন্ধ অনিবার্য জেনেও নিজ কীর্তি রক্ষার জন্য দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে অস্ত্রশিক্ষা দিলেন।

এই বৃত্তান্ত শুনে পাণ্ডবগণ বিষণ্ণ হলেন। কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমরা এই ব্রাহ্মণের গৃহে বহুকাল বাস করেছি, এদেশে যে রমণীয় বন-উপবন আছে তাও দেখা হয়েছে, এখন ভিক্ষাও পূর্বের ন্যায় যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছে না। যদি তোমরা ভাল মনে কর তবে পাঞ্চাল দেশে চলো। পাণ্ডবগণ রাজি হলেন। এই সময়ে বেদব্যাস পুনর্বার তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। নানা কথাপ্রসঙ্গে তিনি পাণ্ডবদেরকে বললেন, কোনও এক ঋষির একটি পরমা সুন্দরী কন্যা ছিল, পূর্বজন্মের কর্মদোষে তার পতিলাভ হয় নি। তার কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব এসে তাকে বর চাইতে বললেন। কন্যা বার বার বললেন, সর্বগুণান্বিত পতি কামনা করি। মহাদেব বললেন তুমি পাঁচ বার পতি চেয়েছো, তাই পরজন্মে তোমার পাঁচটি পতি হবে। সেই কন্যা কৃষ্ণা নামে দ্রুপদের বংশে জন্মেছে, সেই তোমাদের পত্নী হবে। তোমরা পাঞ্চালনগরে যাও, দ্রুপদের কন্যাকে পেয়ে তোমরা সুখী হবে।

পাণ্ডবরা পাঞ্চালদেশে যাত্রা করলেন। এক দিন পরে তারা সোমাশ্রয় তীর্থে গঙ্গাতীরে এলেন। অন্ধকারে পথ দেখবার জন্য অর্জুন একটি জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আগে আগে চললেন। সেই সময়ে গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ স্ত্রীদের নিয়ে গঙ্গায় জলক্রীড়া করতে এসেছিলেন। পাণ্ডবদের কণ্ঠস্বর শুনে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, সন্ধ্যা থেকে সমস্ত রাত্রি যক্ষ-গন্ধর্ব-রাক্ষসদের, অবশিষ্ট কাল মানুষের। রাত্রিতে কোনও মানুষ, এমন কি সসৈন্য কোনো রাজাও যদি জলের কাছে আসে তবে তা নিন্দনীয়। আমি কুবেরের সখা গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ এবং অঙ্গারপর্ণ নামেও পরিচিত, এই বন আমার, তোমর দূরে যাও। অর্জুন বললেন, সমুদ্রে, হিমালয়ের পাশে, এবং এই গঙ্গায় দিনে রাত্রিতে বা সন্ধ্যায় কারও আসতে বাধা নেই। তোমার কথায় কেন আমরা গঙ্গার পবিত্র জল স্পর্শ করব না? তখন অঙ্গারপর্ণ পাণ্ডবদের প্রতি অনেকগুলি বাণ ছুঁড়লেন। অর্জুন তাঁর মশাল আর ঢাল ঘুরিয়ে সমস্ত বাণ থামিয়ে দিয়ে আগ্নেয় অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। গন্ধর্বরাজের রথ পুড়ে গেলো, তিনি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন, অর্জুন তাঁর চুল ধরে টানতে লাগলে, গন্ধর্বের স্ত্রী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমি আপনার শরণাগত, আমার স্বামীকে মুক্তি দিন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অর্জুন গন্ধর্বরাজকে ছেড়ে দিলেন।

গন্ধর্বরাজ বললেন, আমি পরাজিত হয়েছি, নিজেকে আর অঙ্গারপর্ণ বলবো না। আমার বিচিত্র রথ পুড়ে গেছে, আমার এক নাম চিত্ররথ হলেও আমি পরাজিত ও দগ্ধ হয়েছি। যে মহাত্মা আমাকে প্রাণদান করেছেন সেই অর্জুনকে আমার চাক্ষুষী বিদ্যা দান করছি। রাজকুমার, তুমি ত্রিলোকের যা কিছু দেখতে ইচ্ছা করবে এই বিদ্যাবলে তা দেখতে পাবে। আমি তোমাকে আর তোমার প্রত্যেক ভ্রাতাকে একশত বেগবান গন্ধর্বদেশীয় অশ্ব দিচ্ছি, এরা প্রভুর ইচ্ছা হোলেই উপস্থিত হয়। অর্জুন বললেন, গন্ধর্ব, তুমি প্রাণসংশয়ে যা আমাকে দিচ্ছ তা নিতে আমার ইচ্ছা হচ্ছে না। গন্ধর্ব বললেন, তুমি জীবন দিয়েছ, তার পরিবর্তে আমি চাক্ষুষী বিদ্যা দিচ্ছি। তোমার আগ্নেয় অস্ত্র এবং চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব আমাকে দাও। অর্জুন গন্ধর্বের প্রার্থনা অনুসারে চাক্ষুষী বিদ্যা ও অশ্ব নিলেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র দান করে চিত্ররথের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন।

______________

(ক্রমশ)