Jharapata 52 in Bengali Love Stories by Srabanti Ghosh books and stories PDF | ঝরাপাতা - 52

Featured Books
Categories
Share

ঝরাপাতা - 52

ঝরাপাতা

পর্ব - ৫২


🌹💕🌹💕🌹💕🌹

মিলির বুকফাটা কান্নায় প্রথমে রনি দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ও কি বলল, সেটা খেয়ালই করেনি। ভয়ে ভয়ে মিলির পিঠে হাত দিয়ে থামাতে যাচ্ছিল, মিলি ওর হাত ঠেলে দিয়ে আবার বলে ওঠে, "আমাকে যখন পছন্দই করতে না, বিয়ে করে ফেলে গেলে কেন? দিদি তোমাকে বিয়ে করেনি। আমি কি করেছিলাম রনিদা? বিশ্বাস করো, কোনোদিন তোমার কোনো ক্ষতি চাইনি।" কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা উঠে যাচ্ছে মিলির। হাঁপাচ্ছে, অস্পষ্ট শোনাচ্ছে কথাগুলো। 

রনির মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। স্থির চোখে মিলির দিকে তাকিয়ে আছে। মিলির কষ্ট হচ্ছে, ওকে থামাতে হবে, শান্ত করতে হবে, কিচ্ছু মাথায় নেই। গলগল করে ঘামছে রনি। যন্ত্রের মতো ওর ডানহাত নিজের মুখ চেপে ধরে আছে, সেটা নিজেও টের পাচ্ছে না। এতগুলো দিন প্রতি মুহূর্তে চেয়েছে, মিলির সব মনে পড়ুক। তারপর মিলি যত রাগ করুক, ও ঠিক রাগ ভাঙিয়ে দেবে। আজ মিলির এই আকুল কান্নার সামনে সম্পূর্ণ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ভয় করছে, ভীষণ ভয় করছে ওর। ডঃ গিরির চেম্বারে দেখা সেই মৃতপ্রায় মিলিকে মনে পড়ছে। কথা বলতে পারে না, অন্যদের কথা শোনে কিনা বোঝা যায় না। 

সেই মিলিকে মনে পড়তেই বরং মনের জোর ফিরে পায় রনি। আজ ওর সামনে যে মিলি চীৎকার করে কাঁদছে, সেদিনের মিলির সঙ্গে তার তফাৎ আছে। এই মিলি অভিযোগ করে, অভিমান করে, রাগ করে ওকে ঠেলে দেয়, ওর ভালোবাসায় সাড়া দেয়। রনির মনে হয়, ওর ফুসফুস আবার বাতাসে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে, নতুন করে বেঁচে উঠছে ও। এই নতুন জীবনে মিলিকে কখনো ওর কাছ থেকে দূরে যেতে দেবে না। 

যেমন ভাবা, মিলিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধমক দিয়ে ওঠে রনি, "চুপ, একদম চুপ, আর কাঁদবে না, কক্ষণো কাঁদবে না। আমি কোত্থাও যাইনি মিলি। দেখো, মুখ তোলো দেখো, এই যে আমি।" জোর করে মিলির মুখ তুলে ধরে ও। 

রনির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরায়, চীৎকার করে ওঠায়, মিলি চুপ করে গেছে। তখনও কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে, নাকের পাটা ফুলে আছে, চোখের কাজল গালে মাখামাখি। বড় বড় চোখগুলো মেলে রনির দিকেই চেয়ে আছে। কিন্তু আবার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে রনি, ওর বোবা চোখের দৃষ্টি পড়তে অসুবিধা হয় না। ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। 

রনি মুখ নামিয়ে আনে ওর মুখের কাছে, ফিসফিস করে ডাকে, "মিলি, এ্যাই মিলি, সব কথা মনে পড়েছে? তাই রাগ করে ছিলে এতদিন? তাই এসব ভেবেছ?" মিলি আবার কেঁদে ওঠে উত্তরে। 

ওর মাথাটা আবার বুকে চেপে ধরে রনি, "চুপ, চুপ সোনা, কাঁদে না, শোনো না, চুপ করে একবার আমার কথা শোনো, প্লিজ। আমি তোমার কথা শুনিনি, এত কষ্ট দিয়েছি, তুমি আমাকে সেই কষ্টটা ফেরত দেবে? শোনো, আমার কথা শোনো।'' অনেকক্ষণ মিলিকে আদর করে কথা বলে চুপ করায়। হাত ধরে ওকে তুলে এনে খাটের উপর বসায়। পাশে বসে ওর হাতদুটো মুঠো করে ধরে বলে, "মিলি, তুমি জানো না, আমি কবে থেকে তোমাকে এই কথাগুলো বলার অপেক্ষা করছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, সারা পৃথিবীতে শুধু তোমাকে ভালোবাসি, আর কাউকে না। সেটা তোমার সঙ্গে এভাবে সময় কাটানো শুরু করার পর না, আমাদের বিয়ের দিন থেকে। লিলির সঙ্গে বিয়ের ঠিক হয়েছিল, এটা সত্যি। কিন্তু তুমি তো জানো, ওর অন্য প্ল্যান ছিল, ও কথাই বলতে না আমার সঙ্গে। ওর সঙ্গে কোনো মানসিক সম্পর্কই তৈরি হয়নি আমার তখন। শুনতে পাচ্ছ মিলি? আমি কি বলছি বুঝতে পারছ? জল খাবে একটু?" মিলির কান্না বন্ধ হয়েছে বুঝে ওকে জল এনে দিতে উঠতে যায়, পারে না, মিলি ওর হাত চেপে ধরেছে। 

এতক্ষণে পরম শান্তিতে মন ভরে যায় রনির। মিলি ওর হাত ধরে রেখেছে, ওকে ছাড়েনি। অন্য হাত দিয়ে মিলির হাতটা ধরে তুলে চুমু খায়। আদর করে মিলির চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলে, "একটু জল খাও, ভালো লাগবে। অনেক কথা আছে আমার। তোমারও তো নিশ্চয়ই আমাকে অনেক বকুনি দেওয়ার আছে? অনেক শাস্তি দেওয়ার আছে?" মিলি ঠোঁট ফুলিয়ে ওর হাত ছেড়ে দেয় শাস্তির কথায়। রনি এতক্ষণে হাসে, আবার ওর হাতে চুমু খেয়ে উঠে একগ্লাস জল এনে দেয়। মিলির মুখের সামনে ধরে ইশারা করে খেয়ে নিতে। মিলি খাচ্ছে না দেখে পিঠে হাত দিয়ে আদর করে জলের গ্লাসটা ওর মুখে ঠেকায়। এবার মিলি ধীরে ধীরে খানিকটা জল খায়। কয়েক চুমুক জল খেয়ে রনির হাতসহ গ্লাসটাও ধরে রাখে। রনি বুঝতে পারছে, বাঁশপাতার মতো কাঁপছে মিলি। জল খাওয়া হতেই ওকে আবার বুকে জড়িয়ে রাখে রনি। কিন্তু এবার আর কোনো কথা বলে না। 

একটু পর মিলি বোধহয় কিছুটা ধাতস্থ হয়, ধীরে ধীরে রনির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, "রনিদা ছাড়ো, দিদি এসে যাবে।"

- "কেউ আসবে না মিলি। আমাকে শুধু একটা কথা বলো, তাহলে ছেড়ে দেব।"

- "কি কথা?" মিলি অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। এমনিতেই রনি ওকে এমনভাবে জড়িয়ে আছে, এতটুকুও নড়তে পারছে না। আর প্রিয় মানুষটার বুকের মধ্যে থেকে ওর মনের অস্থিরতাও কমে আসছিল। 

- "তোমার আগেই সব মনে পড়েছে, তাই না? কবে মনে পড়েছে? বলো না আমাকে।"

- "তুমি যেদিন আমাকে বাড়ি গিয়ে বকাবকি করলে, সেদিন রাতে।"

- "খুব রাগ করেছিলে না? তাই কিচ্ছু বলোনি আমাকে।" এবার রনি মিলির কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়েছে, "মিলি, বিশ্বাস করো, এই একবার আমাকে বিশ্বাস করো। তোমাকে বিয়ের রাত থেকে ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি আমার জীবনে তখন এসেছিলে যখন কেউ আমাকে বাতিল করে দিয়েছিল, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, সবার হাসির খোরাক করে দিয়ে গেছিল। তুমি তখন আমার ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আমার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে। তোমাকে শুভদৃষ্টির সময় যে দেখেছিলাম, তখন থেকেই ভালোবাসি মিলি।"

- "তাই তো, এত ভালোবেসে ফেললে যে সবার হাসির খোরাক করে রেখে গেলে প্রতিশোধ নিতে।" মিলি ওর হাত ছাড়িয়ে সোজা হয়ে বসেছে। 

রনির আরও নিশ্চিন্ত লাগে, যাক মিলি কথা বলছে, অভিযোগ করছে। অন্ততঃ উত্তর দিতে পারবে ও। রনিও সোজা হয়ে বসে। নিজের চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালিয়ে বলে, "না সোনা। মোটেই প্রতিশোধ নিতে চলে যাইনি। বরং দুদিন ধরে বিয়ের সব নিয়ম কানুনের মধ্যে সবার চোখ এড়িয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। বলতাম, এরকম করে বিয়ে হয়েছে বলে তুমি মন ছোট কোরো না। তোমাকে বিয়ের বোঝা বইতে হবে না। তুমি পড়াশোনা করতে, সময় নিতে। আমি তোমার সঙ্গে থাকতাম। আমার বোন টোনরা এমন তোমাকে ঘিরে রেখেছিল, কথা বলা দূরে থাক, তোমার ধারেকাছেও যেতে পারিনি।"

- "তাই বলে তুমি ওরকম একটা কাণ্ড করলে?"

- "আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম জানো। বন্ধুরা বলেছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে প্রথমেই, তুমি কাউকে ভালোবাসো কিনা। আমি ভেবে দেখেছিলাম, তুমি যদি অন্য কাউকে ভালোবাসো, আমার সামনে দিয়ে চলে যাও, আমি সহ্য করতে পারব না।" রনি কথা বলতে বলতে খেয়াল করে, মিলি ওর কাছে ঘেঁষে এসেছে, ওর জামাটা মুঠো করে ধরেছে। এবার সাহস পেয়ে মিলিকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে বলে, "সব ভুলভাল ভেবেছি, ভুল করে তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছি। তুমি জানো না, এতগুলো মাস আমার কি করে কেটেছে। তোমার সঙ্গে কথা বললেই নিজের মনে হত, তুমি আমার অন্যায়টা ভুলে গেছ, আর আমি তার সুযোগ নিচ্ছি। তাইতেই রেগে যেতাম, উলটো পালটা কথা বলতাম। এবার আমাকে মাপ করে দাও, আর কখনো এরকম কিচ্ছু হবে না। মিলি?"

রনির ডাকে ওকে জড়িয়ে ধরে থেকেই মিলি সাড়া দেয়, "উঁ, কি হয়েছে?"

- "আমাকে মাপ করলে তো? রাগ করে আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?"

- "তুমি তো আমাকে সব কথায় ভুল বুঝবে। পলাশকে নিয়ে যদি ভাবতে পারো......"

- "কিচ্ছু ভুল বুঝব না, দেখো না একবার। যে মেয়েটা আমি চলে যেতে অত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তার জীবনে যে আর কেউ থাকতেই পারে না, সেটা আমি বুঝে গেছি।" মিলির মুখ দুহাতে তুলে ধরে ওর কপালে চুমু খায় রনি। 

যত রনি কথা বলছে, ওকে ভোলাচ্ছে, মিলি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল। রনির উপস্থিতি, ওর স্পর্শ অনুভব করছিল। এত কাছাকাছি কখনো আসেনি দুজন। এখন ওর রাগ হচ্ছিল, লজ্জা করছিল, কিন্তু ভালোও লাগছিল রনির সঙ্গ। রনি আদর করতেই সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠল আবার। রনির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, "কি করছ রনিদা, ছাড়ো। ওরা এসে যাবে।"

- "বলছি তো কেউ আসবে না। ওরা দুজন ইচ্ছে করে বেরিয়ে গেছে, বোঝনি? আমাদের কথা বলতে রেখে গেছে।" রনি পরম নিশ্চিন্তে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছে।"

- "না ছাড়ো, তুমি আমাকে বললে না কেন? আমার সত্যিই কিছু মনে ছিল না, জানো। যেদিন মনে পড়ল, কাকে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তুমি....."

- "জানি, বুঝতে পেরেছি। থাক মিলি, তোমার মন খারাপের দিনগুলো ভুলে যাও। আমি আছি তো, আমি সব ঠিক করে দেব।"

- "তুমি আমাকে বললে না কেন? ভালোই যখন বাসো, বলতে পারতে তো?" মিলি পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেছে। 

- "ডাক্তারের বারণ ছিল মিলি। তুমি জানো না, কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে ! যা যা ভুলে গেছিলে, বলা বারণ ছিল। এমনকি আমাকে এও বলেছিলেন, মানে তুমি সব মনে পড়লে হয়ত আর আমাকে......" রনি চুপ করে যায়। 

- "তোমাকে কি?"

- "থাক না মিলি। বুঝতে পারছ তো, অনেক গণ্ডগোল হয়েছিল। এখন মিটে গেছে, ব্যস। সব বাদ দাও। শুধু আমার কাছে থাকবে বলো, আমাদের বিয়েটাকে মানবে বলো।"

অনেকক্ষণ দুজন মনে করবে না ভেবেও পুরনো সময়কার কথাই বলে। রনি ওর ফোন থেকে বিয়ের ছবিগুলো দেখায় মিলিকে গল্পে গল্পে। ছবি দেখে সেই দিনগুলোর গল্প, খুনসুটি, কাড়াকাড়িতে দুজনের আবার ভাব হয়ে যায়। রনির কাঁধে মাথা রেখে মিলি ছবি দেখছে, রনি একটা একটা করে স্ক্রোল করছে, রিসেপশনের সন্ধ্যার ছবি বেরোতেই চকিতে দুজনের চোখাচোখি হয়। মিলি চোখ সরিয়ে নেয়, রনি ফোন নামিয়ে ঠোঁট কামড়ায়। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে, তারপর বলে ফেলে, "মিলি, আমার কাছে ফিরে আসবে তো? আমার বাড়িতে?"

চলবে