ঝরাপাতা
পর্ব - ৫১
❤💕❤💕❤💕❤
দরজা খুলেই যুগল "ভাইয়া" বলে রনিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। মিলির ভীষণ ভীষণ লজ্জা করছে দিদির মুখোমুখি হতে হবে ভেবে। রনি আর যুগল হাত ধরাধরি করে ভিতরে ঢুকে গেছে। মিলি আর কি করে, টুকটুক করে ওদের পিছন পিছন ভিতরে এসেছে। রনির হাতে একটা বিশাল গিফট প্যাক, ঢুকেই সেটা ও সামনে লিলির হাতে ধরিয়ে দিল, "নাও, তোমার বোন তোমার জন্য কিনেছে। ডিনার সেট। এ্যাই শোনো, এটাতেই আজ আমরা খাব। আমার পকেট থেকে টাকা গেছে আর তোমরা অন্য কাউকে ওপেনিং করতে ডাকবে, তা হবে না।"
ডিনার সেট শুনেই লিলি আর যুগল চোখাচোখি করে, বোঝে, আগেরদিন ওদের সংসারের দৈন্যদশা মিলির চোখ এড়ায়নি। তার মধ্যে মিলি লজ্জা ভুলে ছিটকে ওঠে, "এ্যাই এ্যাই মিথ্যে বলবে না। কে তোমার টাকা চেয়েছে? আমার জন্মদিনে পাওয়া টাকা নিয়ে এসেছিলাম আমি। নাহয় আরেকটু ছোট সেট হত। তুমি ফস করে আমার নাকের ডগায় একটা কার্ড বের করে পেমেন্ট করলে কেন?"
দু বোনই নিজের জন্মদিনের পাওয়া টাকা জমিয়ে রাখত। একসঙ্গে একই রকম ড্রেস কিনত। সেই টাকা নিয়ে এসেছিল মিলি, ওদের জন্য ডিনার সেট কিনতে? লিলির চোখের জল আর বাঁধ মানে না। বোনের গলা জড়িয়ে ধরে আদর করতে গিয়ে দু বোনই কেঁদেকেটে সারা। রনি তাড়াতাড়ি টেবিলে ডিনার সেটটা নামিয়ে রেখে বলল, "ভাই যুগল, থালা বাটি আমি নিয়েই এসেছি। তুমি কি খাওয়াবে, দিয়ে দাও। এরা দু বোন এতদিন পর একটু প্রাণ খুলে কেঁদে নিক।"
মিলি মুখ ফিরিয়ে বলল, "খুব না, সারাদিন আমাদের..... হুঁউউ।"
রনি হেসে ফেলল, "তোমাদের বলব না? দু বোনকে সেদিন পয়সা খরচ করে রেস্টুরেন্টে খেতে ডাকলাম, এসো, খাও, গল্প করো। না, পোষালো না তোমার। এখন বুঝেছি, ওখানে গলা ছেড়ে কাঁদলে গলাধাক্কা দিত।"
- "দিদি দেখেছিস?" মিলি তাড়াতাড়ি দিদিকে দলে টানে।
- "হ্যাঁ তোমার দিদি দেখেছে। এবার বলো কি খাওয়াবে? রান্না কমপ্লিট?" রনি ভাবে তাহলে খেয়ে দেয়ে মিলিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।
- "রান্না করিনি আমরা।" লাজুক হেসে লিলি বলে।
- "এ্যাঁএএএ" রনির সব স্মার্টনেস উধাও। যুগল কি শোধ নিতে ডাকল?
- "হয়েছে কি বলোতো, আমরা কি রান্না হবে সব ঠিক করেছিলাম......"
- "তারপর দেখলি, একটাও তুই রাঁধতে জানিস না।" মিলি হেসে গড়িয়ে পড়ে।
- "মানে?" রনি আরও অবাক, যুগল মিটিমিটি হাসছে।
- "মানে? মানে হল, দিদি রান্নাই করতে জানে না। খালি ভাত রুটি করতে জানে আর আলু ভাজা করতে।" মিলি খি খি করে হেসেই যাচ্ছে।
- "মোটেই না, মিথ্যে কথা বলছে রনিদা।" লিলি হাত নেড়ে তড়বড় করে বলতে থাকে, "আমি আলুচোখা করতে পারি, সবজি ডাল করতে পারি, চিকেন কষা করতে পারি। মাছ টাছ কেটে ধুয়ে রান্না করতে পারি না। তা যুগলও মাছ খায় না, ওসব লাগে না।"
- "বুঝেছ?" যুগল রনিকে একটা সি *গা *রে *ট দিয়ে ছোট্ট ব্যালকনিটার দিকে টেনে নিয়ে যায়।
ততক্ষণে হাসি বন্ধ করে খাড়া হয়েছে মিলি, "ওরে আমার রাঁধুনি রে, আলুচোখাও রান্না, আর তুইও চিকেন কষা করতে পারিস ! চিকেন ধুয়ে পরিষ্কার করতে পারিস?"
সকাল থেকে যুগল চিমটি কাটা কথা শোনাচ্ছে, বিরিয়ানি, চাঁপ, চাইনিজ কোনো প্রিপারেশন, এমনকি বাসন্তী পোলাওয়ের মতো বাঙালি রান্নাও লিলি পারবে না বলে হাত তুলে দেওয়ায়। তার উপর মিলি সব ফাঁস করে দিচ্ছে। লিলি ফুঁসে ওঠে, "এখন পারি। শিখে নিয়েছি। আর কিছুদিন যেতে দে, আরও শিখে যাব। আর পারি না বলে যে হাসছিস, আমি তো মেক্সিকান ওমলেট করতে পারি, তুই পারিস?"
- "ওটা আবার কবে শিখলি?" মিলি ঘাবড়ে গেছে বিদেশি নামের ঘায়ে।
- "তবে? ইউ টিউব দেখে শিখেছি, বুঝলি? আমরা মাঝে মাঝে রাতে খাই। বেশ কন্টিনেন্টাল।"
যুগল রনির কানে কানে বলে, "বহুত খারাব চিজ ওহ ওমলেট।"
- "বুঝেছি" রনি ঘাড় নাড়ে, "একবোন বিক্রম খান্না আর অন্যটা রণবীর ব্রার। আমাদের দুজনের কপালেই জুটল।"
রনির ফিসফিসানি এরা শুনতে পেয়ে গেছিল। তেড়ে উঠতেই রনি সারেন্ডার করল, "আচ্ছা বাবা ঠাট্টা করা উচিত হয়নি। এখন খাবে কি সেটা বলো। আমি অর্ডার করছি।"
- "অর্ডার করে দিয়েছি।" যুগল নিশ্চিন্ত করে, "আর দশ পন্দ্রা মিনিটে আসছে। সাদা ভাত, নবরত্ন ডাল, বেগুনি, পত্রানী মচ্ছি, দই কাতলা, বাসন্তী পোলাও, মাটন কষা, চাটনি, পাঁপড়, রসগুল্লা।" ঝরঝর করে বলে যায় যুগল, একটা বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের নাম বলে, যেখান থেকে খাবার আসছে।
রনি বলতে যাচ্ছিল, "এ তো ভাব হওয়ার নয়, একেবারে বিয়ের ভোজ।" সামলে যায়, ওদের বিয়েতে এটাই মেনু ছিল। বুঝতে পারে, নামীদামী পদ লিলি রান্না করতে পারবে না টের পেয়ে যখন ওরা বাইরে থেকে খাবার আনাবে ঠিক করেছে, তখন ইচ্ছে করেই এই মেনু বেছেছে। মিলির কি কিছু মনে নেই? আড়চোখে একবার মিলির দিকে তাকাতে গিয়ে দেখে, মিলিও চোখের কোণে ওকেই দেখছে। ও তাকাতেই মুখ ফিরিয়ে নিল।
ঘরের আবহাওয়া হঠাৎ ভারী হয়ে যেতে যুগল ঠেকা দিতে বলে, "লিলি কিন্তু রান্না পারে। সবকুছ না হলেও থোড়া থোড়া। ঔর শিখছে। আমিই কুছু পারি না। তাই তো ওর মুশকিল হয়ে যায়।"
- "এইসব প্রশংসা না করলে কাল থেকে দিদি খেতে দেবে না বলো?" মিলি ফিক করে হেসে ফেলে আবার। যুগল আর লিলিও হাসছে। রনির চোখটা জ্বালা করে ওঠে। যুগল কি সুন্দর বলতে পারছে, লিলি কি পারে আর কি পারে না। ও আর মিলি তো কখনো একসঙ্গে সংসারই করতে পারল না।
ভাগ্যিস খাবার এসে যায়। সত্যিই একগাদা খাবার অর্ডার দিয়েছে ওরা। দু বোন চটপট নতুন ডিনার সেট খুলে ধোওয়া মোছা করতে যায়। যুগল আর লিলি জোর করে মিলিকে সরিয়ে দেয়, ওর শাড়ি খারাপ হয়ে যাবে। দুজনে ডিনার সেট পরিষ্কার করে, রনি আর মিলি তাকিয়ে থাকে, কি সুন্দর দুজনে মিলে অতিথি আপ্যায়ন করছে ওরা।
অবশ্য খেতে দেয় দু বোন মিলে। খাটে আর চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসে চারজন খায়, গল্প করে, এ ওর পিছনে লাগে, হেসে গড়িয়ে পড়ে। খাওয়ার পরেও বসে থাকে গল্পের নেশায়। শেষে যখন এঁটো হাত শুকিয়ে খটখটে, তখন উঠে হাত ধোয়।
লিলি বলে, "দেখেছ, তুমি বলেছিলে, ওরা আসার আগেই মিষ্টি মৌরি মশলা কিনে আনবে, মিলি ভালোবাসে। সে আর গেলে না।"
মৌরি মশলা আনবে কি, যুগল তখন ঘাড় থেকে বাজারের হ্যাপা নেমেছে বলে লিলিকে আদর আহ্লাদ করতেই ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া আরেকটা প্ল্যানও দুজনের হয়েছিল। তাই লাফিয়ে ওঠে, "ওহ হো, ভুল হয়ে গেছে। মিলি দশ মিনিট। রাস্তার ওপারের পানের দোকানেই আছে। আমি যাব আর আসব।"
- "না না যুগলদা, যেতে হবে না।" মিলি বাধা দেয়।
রনিও বলে, "এখন তিনটে বাজে, ছেড়ে দাও। আরেকটু গল্প করে বেরিয়ে যাই। শীতকাল, ঝপ করে সন্ধে হয়ে যাবে।"
- "আরে না, এই তো সামনে। দোকানটা সারাদিন খোলা থাকে। ও এক্ষুণি নিয়ে আসবে।" লিলি এদের কথা উড়িয়ে দেয়। যুগল অবশ্য ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে।
রেস্টুরেন্টটার রান্না সত্যিই ভালো, এই নিয়ে আবার একপ্রস্থ প্রশংসা করে তিনজন। একটু পরেই লিলির ফোন বাজে, যুগল ওপাশ থেকে বলে, "এবার বেরিয়ে পড়ো।"
লিলি হুঁ হুঁ করে শুনে বলে, "আরে আমাদের বাড়িওয়ালা একটু ডাকছে। কি পিকনিক হবে তাই নিয়ে। শুনে আসি দাঁড়াও।" তড়বড় করে বেরিয়ে যায়। এরা তো জানে না, পিকনিক নিয়ে আলোচনা গতকাল রাতেই হয়ে গেছে।
💕🌹💕🌹💕🌹💕
মিলি উঠে ব্যালকনির দিকে সবে পা বাড়িয়েছে, রনির এক টানে ওর প্রায় গায়ের উপর এসে পড়ে। টাল সামলাতে রনির শার্টটাই আঁকড়ে ধরে বলে, "কি করছ? ওরা এসে যাবে।"
- "তুমি আগে বলো, কি করছিলে?"
- "আমি আবার কি করছিলাম?" মিলির বুক ঢিপঢিপ করছে যদিও, তাও বুঝতে দেয় না।
ততক্ষণে রনি ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছে, "আমার সঙ্গে কথা বলছিলে না কেন? সেদিন আমার অসুখ শুনেও আমার ঘর থেকেও চলে গেলে, কাল রেস্টুরেন্টে লোকজনের সামনে, নিজের দিদির সঙ্গে কথা না বলে চলে গেলে। এগুলো ঠিক করছিলে?"
মিলি এবার ওর শার্ট ছেড়ে উলটো দু হাতে ঠেলতে শুরু করেছে ওর হাত ছাড়াতে, "ছাড়ো না প্লিজ, যুগলদা এসে যাবে।"
রনি খুব ভালোই বুঝেছে, এটা যুগলের প্ল্যান, ওরা এখন আসবে না। তাই মাথা নাড়ে, "যেই আসুক, আমার কথার উত্তর দাও।"
- "তোমার কোনো কথার উত্তর দেব না। হয়েছে? কি করতাম আমি? তুমি দিদির ব্যাপারে সব কথা লুকিয়ে রেখেছিলে। আমি কি ভাবব, কি বুঝব?"
- "তো কি বলব? সময় পেয়েছিলাম ওর কথা বলার? তুমি তো এ বাড়িতে এসেই খেপে গেলে। আমি যখন মুভি দেখার পর তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম, বুঝবে না সব বলতে চাই?"
- "আমি ভেবেছিলাম, তুমি ওটাই বলবে, তুমি দিদিকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলে। এখন দিদির সঙ্গে তোমার ভাব। আমি যেন এটা বুঝি।" মনের কষ্ট চেপে একটা একটা শব্দ বলে মিলি।
- "কি ভাবো আমাকে? তোমাকে আমার সব কথা বলেছি। তারপর এইটা ভাবলে? ভাবতে পারলে? আমিও তো পলাশকে দেখি। পলাশ অতবড় অন্যায় করল, তার পরেও ওর সঙ্গে ভাব !"
- "ও, তাহলে তুমি শুধু সবার সামনে অকারণে বকলে তা নয়, পলাশকে জড়িয়ে একটা গল্প বানিয়ে নিয়েছিলে, যাতে আমার সঙ্গে সম্পর্কটা শেষ করতে পারো। বাহ।"
- "মোটেই গল্প বানাইনি। আমার মনে হয়েছিল, তোমার যদি পলাশের জন্য কোনো ফিলিংস থাকে, তাহলে সেটাই বেছে নাও। সেজন্য তোমাকে সময় দিতে চেয়েছিলাম। সেটা করতে আমার কি হচ্ছিল জানো?" রনি গোঁজ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে।
মিলি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, "সেটাই বেছে নিলাম, ঠিক আছে? আসছি।"
- "মিলি, চুপ করে বোসো, যথেষ্ট জ্বালিয়েছ আমাকে।" রনি ওর হাত চেপে ধরে থামায়।
- "হাত ছাড়ো। একদম আমার হাত ধরবে না। পলাশ কি করেছে না করেছে, তার সব দোষ আমার ঘাড়ে দিয়ে যাচ্ছ।"
মিলিকে ধরে রেখেই ওর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে বিছানায় রেখে দেয় রনি, "দোষ দিইনি মিলি। আমি বুঝতে পারিনি। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমিও লিলির সম্পর্কে ভুল ভেবেছ, আমিও পলাশকে নিয়ে। এখন......."
- "দিদি আর পলাশ এক হল? দিদির সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আর আমার নামে একটা মিছিমিছি কথা বানিয়ে তুমি...." এবার মিলি আবার চেয়ারটায় বসে পড়ে।
- "মিছিমিছি? আমি কিছু ভাবলে মিছিমিছি। আর তুমি যে ভুলভাল ভেবে নিয়ে এই এতগুলো দিন ধরে...... সেদিন আমার জ্বর দেখেও একবার খবরও নিলে না। আমাদের বাড়িতে কতবার সরি বললাম, আমার কথাটা শুনতে বললাম। কলেজে গেলাম দেখা করতে, তাও বাসে উঠে গেলে।"
- "কেন ভাবব না? তুমি দিদিকে মানে দিদিকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলে। তাহলে ওকে ভালোবাসো ভাবাটা ভুল?" মিলির চোখ জলে ভরতে শুরু করেছে।
রনি ওর চোখে জল দেখে বরং আরও রেগে উঠে বলে, "সব জেনে এইসব আবোল তাবোল ভাবো বসে বসে ! পাগল কোথাকার ! জান না, লিলি কাকে ভালোবাসে? জান না, আমাকে বিয়ে করতে চায়নি?"
- "দিদি বিয়ে করতে চায়নি। তুমি তো চেয়েছিলে?"
- "মিলি, সেই বিয়েটা বড়রা সবাই ঠিক করেছিল। আর তোমাকে আমি নিজে বলেছি ভালোবাসি....."
- "না, দিদিকে তুমি নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করতে যাচ্ছিলে। আর আমার সঙ্গে সবাই জোর করে বিয়ে দিয়েছে তোমার।" মিলি টেবিলে মাথা রেখে হউহাউ করে কাঁদতে থাকে।
চলবে