I found you on the wrong path - 1 in Bengali Love Stories by MOU DUTTA books and stories PDF | ভুল পথে পেলাম তোমাকে - Part 1

Featured Books
Categories
Share

ভুল পথে পেলাম তোমাকে - Part 1

ভুল পথের শুরু, নতুন কারো আগমনের গন্ধ

সারা দিনটা অদ্ভুত রকমের ভারী গিয়েছিল ইরার। ক্লাসগুলো শেষ হয়েছিল বিকেল চারটায়, কিন্তু মনটা যেন কোনোকিছুতে ঠিকমতো লাগছিল না। সহপাঠীরা সবাই ক্যাম্পাসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল, কেউ ক্যান্টিনে, কেউ গাছতলায় দাঁড়িয়ে, কেউ সিগারেট হাতে হাসাহাসি করছিল—কিন্তু ইরা সবসময়ই এদের ভিড়ে নিজেকে বেমানান মনে করে।

তার চোখে ভিড় মানে শব্দ, চাপ, আর নিজের ভেতরের অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া। তাই অনেকটা নিঃশব্দে, আর কারো দৃষ্টি এড়িয়ে কলেজের ফটক দিয়ে বেরিয়ে এল সে।

আকাশ তখনো হালকা নীল। নভেম্বরের বিকেল। হাওয়ার মধ্যে শীতের খুব অল্প গন্ধ।
ইরা হাঁটছিল ধীরে—যেন কোথাও পৌঁছানোর তাড়া নেই, আবার ঠিক পৌঁছানোর জায়গাটাও নেই।

আজ অদ্ভুত এক ক্লান্তি ছিল তার চোখে, মনেও।
নিজের ভেতরের একাকীত্বটাকে সে আজ যেন একটু বেশি অনুভব করছিল।

কলেজের সামনে থেকে সাধারণত যে বড় রাস্তাটা ধরে বাস ধরে বাড়ি যায়, সেই রাস্তা ধরে এগোনোর আগেই হঠাৎ তার মনে হলো—
আজ একটু অন্য রাস্তা দিয়ে গেলে কেমন হয়?

কি আশ্চর্য!
যে ইরা সবসময় নিয়ম মেনে চলে, যেখানে ভুল করার ভয় তাকে থামিয়ে রাখে—সে-ই আজ হঠাৎ করে একটা নতুন পথ বেছে নিতে চাইলো।
নিজেই বুঝলো না কেন।

হয়তো কোনো এক অদ্ভুত টান
হয়তো কোনো আগাম অনুভূতি
হয়তো সেই মুহূর্তে ভাগ্যের হাতটাই তাকে টেনে নিচ্ছিল এক অন্যদিকে।

ইরা মোবাইলটা বের করে দেখল ম্যাপে একটি শর্টকাট দেখাচ্ছে।
রাস্তাটা সোজা নয়—একটা সরু গলি দিয়ে ঢুকে পাশের বড় রাস্তায় বের হওয়া যায়।

ইরা একটু দ্বিধায় পড়ল।
গলি?
হাঁটাপথে?
একাই?

তারপরও কেন যেন মনে হলো—আজ কিছু নতুন হতে পারে।
আজ সে একটু নিজের বাইরে বেরোতে চায়।

গলিটার সামনে দাঁড়াতেই সে থমকে গেল।
আলো অল্প, দু’পাশে পুরনো বাড়ির দেয়াল, জানালা দিয়ে শীতের হাওয়ায় পর্দা উড়ছে।
মাঝে মাঝে ঝুলে থাকা ইলেকট্রিক তারগুলো শব্দ করছে।
রাস্তা নিঃশব্দ।

ইরার বুক ধক করে উঠল।
তবে ভয় নয়—এটা ছিল অদ্ভুত এক অনুভূতি, সে নিজেও সংজ্ঞা দিতে পারছিল না।

হঠাৎই মনে হলো—যেন কেউ ওকে ডাকছে।
কেউ নেই, তবুও মনে হলো ওর জন্য কেউ অপেক্ষা করছে।
এই গলির ভেতর কোথাও।

ইরা গভীর শ্বাস নিল।
ধীরে পা বাড়াল।

গলির ভেতর যতই ঢুকছিল, আলো তত কমছিল।
মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলে উঠল।
ম্যাপ বলল—
“WRONG DIRECTION”

ইরা বিরক্ত গলায় বলল,
— “উফ! ভুল পথে চলে এলাম।”

ঠিক তখনই।

একটা কণ্ঠ…
একটা মিষ্টি, উচ্ছল, চঞ্চল, আলোভরা কণ্ঠ…
পেছন থেকে ভেসে এল।

— “এই যে! তুমি কি পথ হারিয়েছ?”

ইরা ঘুরে দাঁড়াল।
চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।

সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক মেয়ে।
চুল ভেজা—হয়তো একটু আগেই বৃষ্টি বা জল পড়েছে।
চোখ দুটো গভীর, যেন ভেতরে একটা আলো লুকিয়ে আছে।
গাল ভরা হাসি—যা দেখে মনে হয় অন্ধকার গলিও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

সে মেয়ে বলল—
— “আমি মায়া। তুমি এখানে নতুন?”

ইরা কথা হারিয়ে ফেলল।
এই মেয়ে কে!
এত হাসছে কেন?
এত সহজে কথা বলছে কেন?

— “ন… না। আসলে আমি ভুল পথে এসে পড়েছি।” — ইরা আস্তে বলল, একটু লজ্জা পেয়ে।

মায়া হেসে উঠল— সেই হাসি ছিল স্বাভাবিক, খাঁটি, হৃদয়-ভাল করা হাসি।
যেন সে সারা জীবন এই রকম অচেনা মেয়েদের ভুল পথ থেকে তুলে এনে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছে।

— “ভুল পথে আসলে ঠিক মানুষকেই পাওয়া যায় কখনও কখনও।”

মায়া কথাটা এমন সহজে বলল—
যেন কথার মাঝেই একটা লুকোনো মানে আছে।
যেন ও জানে…
আজ এই ভুল পথটায় ইরার জীবনে কিছু বদলে যাবে।

ইরার বুক হালকা কেঁপে উঠল।
প্রথমবারই সে কোনো অচেনা মেয়ের চোখে এমন স্বস্তি, এমন উষ্ণতা দেখল।

মায়া এগিয়ে এল।
তার ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাল।

— “আচ্ছা, এই গলি দিয়ে আসলে শর্টকাট হয় ঠিকই, কিন্তু তুমি ভুল মোড় ধরেছ। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি… চলো।”

ইরার মাথা একটু ঘুরে গেল।
কেউ কখনো ওর প্রতি এত সহজে যত্ন দেখায়নি।
ওকে দেখে এত সহজে হাসেনি।
এভাবে দিকও দেখায়নি।

দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
মায়া সামনে পথ দেখাচ্ছে, ইরা তার পেছনে হাঁটছে—
মাঝেমধ্যে মায়া পিছনে তাকিয়ে হাসছে, আর ইরার হৃদয় লাফিয়ে উঠছে।

ইরা জানত না—
এমন একটা অচেনা মেয়ের হাসি তাকে এত কীভাবে টানছে।

হঠাৎ হাওয়া বইল।
মায়ার চুল উড়ে এসে ইরার গালে লাগল।
নরম, ভেজা গন্ধ।
ইরা এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল।

মায়া চোখ ঘুরিয়ে বলল,
— “কী হলো? ভয় পেয়েছ?”

ইরা মাথা নাড়ল,
— “না… শুধু… জানি না… তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি মনে হয়।”

— “দেখেছ? নাকি দেখার অপেক্ষায় ছিলে?”
মায়া চোখ টিপে হেসে উঠল।

ইরা এতটাই লজ্জা পেল যে শব্দ বের হল না।
তার বুকের ভেতর কেমন একটা নরম আতঙ্ক, উষ্ণতার সাথে মিশে থাকা।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে গলি থেকে বড় রাস্তায় এসে পড়ল।
রাস্তায় আলো, মানুষ, গাড়ির শব্দ—সবই ফিরে এল।

কিন্তু ইরার ভেতরের পৃথিবী বদলে গেছে।

মায়া বলল,
— “এই যে, এখান থেকেই বাস পাবে।”

ইরা নিঃশব্দে মাথা নেড়ল।
যেন বলতে চাইছে—
আরো একটু থাকো।
আরো কিছু বলো।
এভাবে হাসো।

অচেনা মেয়ের কাছে এমন টান—
সে আগে কখনো অনুভব করেনি।

মায়া হঠাৎ বলল,
— “শোনো, ইরা… কাল যদি তোমার সময় থাকে, তবে এই গলির মাথায় একটু দাঁড়াবে? আমি আসব। তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।”

ইরার মন কেঁপে উঠল।
কাল?
আবার দেখা?

সে কিছু না বলতেই মায়া বলল,
— “তুমি অবশ্যই আসবে। আমি জানি।”

এই বলে মায়া হাঁটতে শুরু করল।
কিছু দূর গিয়ে পিছন ফিরে তাকাল—
এবার তার চোখে একবার যে দৃষ্টিটা দেখা গেল,
ইরা বুঝল—

এই ভুল পথটা স্রেফ রাস্তার ভুল নয়।
এটা তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে দিয়েছে।

মায়া চলে গেল।
ইরা স্থির দাঁড়িয়ে রইল।

হাওয়ায় আবার মায়ার ভেজা চুলের গন্ধ ভেসে এল—
নাকি সেটা তার নিজের কল্পনা?

বাসস্ট্যান্ডে যেতে যেতে ইরার মনে শুধু একটাই কথা ঘুরছিল—

“আমি কি তাকে আবার দেখতে যাব?”

যেন উত্তরটা সে জানেই।
যেন হৃদয় অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

এই ভুল পথে আসা—
এই অচেনা মেয়ে—
এই হাসি—
এই অদ্ভুত টান—

সবকিছুই যেন বলে দিচ্ছিল—

এটা শুধু পথ হারিয়ে ফেলা নয়।
এটা কারো জীবনে ঢুকে পড়া।
এবং হয়তো…
তার নিজেরই জীবন কেউ না জানিয়ে বদলে দিতে এসেছে।


---