ঝরাপাতা
পর্ব - ৪১
❤💕❤💕❤💕❤
আরও সাতদিন, এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। মিলি সকালে পারতপক্ষে বারান্দায় যায় না। রনির সঙ্গে যেন দেখা না হয়। দেখা হয়ও নি একবারও। রনিকে একবার দেখার, একবার কথা বলার ইচ্ছে যত দমন করতে পেরেছে, তত নিজের উপর বিশ্বাস, ভরসা বেড়েছে মিলির। আর সেটা ওকে পড়াশোনায় অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে।
তার সঙ্গে সঙ্গে পলাশের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা খুব ভালো হয়ে উঠেছে। মিলি যে কোনো অভিযোগ করল না, বরং ওর অন্যায় গোপন রেখে আরেকটা সুযোগ দিল, এটা পলাশের জীবনে প্রথমবার ঘটল। ফলে ও আরও বেশি ভক্ত হয়ে পড়ল মিলির। খুব বেশি আড্ডা গল্পে প্রশ্রয় দেয় না মিলি। পলাশও ওর সঙ্গে পড়াশোনার কথাই বলে। তবে যে বয়সের ছেলে মেয়ে, দল বেঁধে পড়ার কথা শুরু হলেও সেখানে সিনেমা, জোকস আর সবার ক্রাশের গল্পই শেষে জায়গা করে নেয়। ফলে খুব সহজ সুন্দর মজাদার সময় কাটছে বলে পলাশ আর মিলি, দুজনেই বেশ ঝলমলে হয়ে উঠেছে। পলাশ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। মিলিও নিজের সমস্যাগুলো ভুলে থাকে। পলাশ যে বন্ধুত্বটা টিঁকিয়ে রাখতে যেমন ক্ষমা চেয়েছিল, তেমনি নিজের ব্যবহারেও বদল এনেছে, এতে মিলিরও ওকে খুব ভালো লাগছে।
মিলির সঙ্গে আর কলেজ চত্বরে রনিকে দেখা যায় না। এটাতেও পলাশের মন বেশ ভালো। একটু কায়দা করে জিজ্ঞেস করে সেটাই জেনেছে, যেটা মিলি বলেছে, ও এখন একাই যাতায়াত করতে পারে।
এতে পলাশের মনে হয়েছে, মিলির জীবনে কি তবে রনির দরকার ফুরিয়েছে? নয় কেন? রনির সঙ্গে সম্পর্ক মিলি জানে না। তাই সুস্থ হতেই প্রথমে রনির সঙ্গে ঘোরা বন্ধ হয়েছে। অর্থ্যাৎ দরকারের বাইরে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি রনির সঙ্গে। রনি হয়ত গড়বেও না সেই সম্পর্ক। তার মানে মিলির সঙ্গে একমাত্র বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্ব পার হয়েও আরও কাছের সম্পর্ক ওর সঙ্গে গড়ে উঠতে পারে স্বপ্ন দেখছে পলাশ।
তবে আজ সেই সুন্দর সম্পর্কে আবার নতুন একটা ধাক্কা লাগল। কলেজেই একফাঁকে পলাশ মিলিকে বলেছিল, ওর সঙ্গে একটু কথা আছে। কথাটা দরকারী এবং গোপনও। অঙ্কুরও যেন না জানতে পারে। তাই ছুটির পর অঙ্কুরের সঙ্গে না বেরিয়ে পলাশ আর সুলগ্নার সঙ্গে গল্প করছিল মিলি। অঙ্কুর এগিয়ে যেতেই সুলগ্নাকে টা টা দিয়ে দেয় দুজন। এবার পলাশের ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোল।
তিনদিন আগে সন্ধ্যায় পলাশ ওর এক বন্ধুর সঙ্গে একটা রেস্টুরেন্টের কাছে দোকানে গেছিল। তখন রনি আর লিলিকে সেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে দেখে। খটকা একটা লেগেছিল, তবুও ভেবেছিল দু বাড়িতে হয়ত ভাব হয়ে গেছে, মিলিরা দিদিকে মেনে নিয়েছে। তাই মিলিকে কিছু বলেনি, তবে অঙ্কুরকে গল্পে গল্পে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, দিদিকে ওরা কেউ মানেনি, মানবে না।
মিলি ততক্ষণে ঘামছে। ও নিজেই যে দিদির ফ্ল্যাটে গেছে ! বাড়িতে কেউ জানে না। আর এখন যা হয়ে গেছে, রনিদার সঙ্গে কোথায় কোথায় গেছে, এ গল্প করাও যাবে না। ঘামতে ঘামতেই শুনল, পলাশ দুজন লোক লাগিয়েছে রনি আর লিলির উপর নজর রাখতে। তারা গতকাল রবিবার দুপুরে দুজনকে আবার রেস্টুরেন্টে দেখেছে, কিছু ছবিও তুলেছে। পলাশের ফোনে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা একটা করে দেখায় পলাশ। কলেজের কাছে স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুজন, একটু আড়ালে কোথাও হলে মিলি বোধহয় কেঁদেই ফেলত। ছবিগুলোতে যথেষ্ট ঘন হয়ে পাশাপাশি বসে কথা বলছে রনি আর লিলি। শেষ ছবিটায় রনির কাঁধে হাত রেখে ওর বাইকে বসে লিলি।
- "তোদের নিজেদের ব্যাপার, কিন্তু আমার এই ছেলেটাকে ঠিক লাগে না রে অদ্রিজা। আগে আগে যতবার বলেছি, তুই বিরক্ত হয়েছিস। এখনও তোর ভালো লাগছে না জানি। কিন্তু তুই এটা বলত, একে বিয়ে করেনি বলে তোর দিদিকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছিস না তোরা, অথচ ওরা দুজন দিব্যি একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোর দিদিকে এই রনিদাই ভাগায়নি তো?"
আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে মিলি। এই দিকটা কখনো ভাবেনি। দিদির সঙ্গে রনিদার সব প্ল্যান হয়েছিল? ওরা দুজন প্ল্যান করে দিদি যুগলদাকে বিয়ে করেছে? তাহলে সেদিন যখন মিলি ওদের ফ্ল্যাটে গেল যুগলদা কি নিয়ে বিরক্ত ছিল?
নিজের কষ্ট ছাপিয়েও মিলি বুঝতে পারে, বড় সহজ নয় গল্পটা। পলাশের হাত ধরে বলে, "পলাশ আমার শরীর ভালো লাগছে না। একটু সঙ্গে যাবি বাড়ি পর্যন্ত?"
- "এ বাবা, শরীর খারাপ লাগছে?" ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে মিলির হাত ধরে পলাশ, "সরি রে, তোকে এসব বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি ভয় পাই এই ছেলেটাকে। ও তোর কোনো ক্ষতি না করে। তাই, সাবধান করতে বললাম। তুই ভাবিস না। আমার লোক ওকে চোখে চোখে রাখবে। তুই চল, বাড়ি চল। আমি দিয়ে আসছি।"
💜💕💜💕💜💕💜
আজ রনি ব্যালকনিতে না থাকলেও পলাশ আর মিলিকে একসঙ্গে ফিরতে দেখে পিউ। বাড়ির সামনে এসেও পলাশ ভিতরে ঢোকে না, অথচ মিলি বাড়িতে ঢোকার আগে বেশ খানিকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা বলে দুজন, সবটাই নজর করে ও। পলাশকে আগে না দেখলেও ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে, এই ছেলেটিই পলাশ। আর যদি পলাশ হয়, কলেজের ঘটনার পরও মিলি ওর সঙ্গে মিশছে, বাড়ি পর্যন্ত আসছে। তবে কি ঐ ভাবনাটাই ঠিক, পলাশের সঙ্গেই আসলে মিলির বিশেষ সম্পর্কটা?
কাকে যে এই দুশ্চিন্তার কথা বলবে ভেবে পায় না ও। প্রতিবার স্বপ্ন সাজিয়েছে ও, সেই স্বপ্নের শতহাত দূর দিয়ে গেছে বাস্তব। বনি শেষবারের মতো রনিকে মিলির কাছ থেকে সরে থাকতে বলেছিল। সেটাও ওর মনঃপূত হয়নি। আর আজ রনি তার ফল ভোগ করছে। এরপর যদি রনির চোখের সামনে পলাশের আনাগোনা শুরু হয়, মিলির বাড়িতে পলাশকে মেনে নেয়......। পিউ আর ভাবতে পারে না।
মণিকাকে টেনে নিয়ে আসে ঘরে, "মামনি, একটু শোনো, একটা কথা আছে।" রনির কাছে টুকাই আছে, রনি চট করে এখন মায়ের ঘরে আসবে না। পিউ মণিকাকে বলে আজকের কথা।
- "কি বলি বলত? যদি শুধু দুজনের ঝগড়াঝাঁটি হত, ছেলেকে শাসন করতাম। মিলির সঙ্গে, গোপাদের সঙ্গে কথা বলতাম। ঐবার যেমন বললাম। কিন্তু এ তো অন্য ব্যাপার। রনি বলছে, ও মেয়ে এই ছেলেকে ভালোবাসে। আজ তুইও দেখলি। এখানে তো রনির সরে যাওয়াই ঠিক।"
- "সরে যেতে তো ভাই পারেনি এখনও। মিলির সঙ্গে দেখা না করা, ওদের বাড়ি না যাওয়াই কি সরে যাওয়া? আর ওর বাড়ির লোকই বা কি ভাবছে, জানতে হবে। এই দুদিন আগে ভাইকে পছন্দ ছিল। চব্বিশ ঘন্টা মেয়ের সবেতেই ভাইয়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। আজ দশদিন হতে গেল, ছেলেটার একটা খবরও নিচ্ছে না?"
- "তা কি করবি? ওদের সঙ্গে ঝগড়া করবি? ঝগড়া করে ঐ ছেলেকে তাড়িয়ে রনির সঙ্গে মিলিয়ে দিবি?" মণিকাও বিরক্ত।
- "উঁহু, সেটা যে হয় না ঐটুকু জ্ঞান আছে। আমি শুধু ওদের মনের কথা জানতে চাই। কারণ আর অপেক্ষা করলে হবে না। আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভাইকে সামলাতে হবে মামনি।"
- "আমি বাপু তোমার প্ল্যানে নেই। রনি বলেই দিয়েছে মিলির পরীক্ষার আগে...."
- "পরীক্ষা মিলির, ওর বাবা মায়ের তো নয়। ওদের সঙ্গে একবার কথা বললে কি হয়? আর সব কথাই কি বলে ফেলব? যাব, হাবভাব দেখব। ওর পরীক্ষা শেষ হতে হতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হয়ে যাবে। ভাইয়ের ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। তেমন বুঝলে এখন একবার তুমি আর ভাই কোথাও ঘুরে এসো। ছেলেটার একটু চেঞ্জ হোক। বনি কলেজের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, আমি ওর সঙ্গে থাকছি।"
মণিকা দু পাঁচ মিনিট ভাবে, "কথাটা ঠিক, হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। এই বিয়ে টিঁকবে না, এটা পরিষ্কার। তার জন্য ছেলে মেয়ে দুজনেরই যথেষ্ট ভোগান্তি হল। এবার সব মেটাতে হবে। দরকার হয়, দুই বাড়িতে সবাই বসে খোলাখুলি কথা বলে সেই অনুযায়ী চলতে হবে। এমনিতেই আজকাল ছেলের বাড়ি, ছেলের মায়ের সহস্র দোষ। তার উপর দুবার রনি দুরকম কাণ্ড করে ফেলেছে। এখন সম্পর্ক শেষ করতেও মেয়ের বাড়ির মতেই চলতে হবে। আর যেহেতু তারাও জানে এ্যাডভান্টেজ ওদের দিকে, তাই চুপ করে বসে আছে। আমি বসে থাকলে হবে না। আমাকে এগোতে হবে।"
পরদিন একটু বেলায় গুটিগুটি শাশুড়ি বৌ গোপার কাছে উদয় হয়। কিভাবে কথা শুরু করবে, কতদূর বলবে আর কতদূর জানার চেষ্টা করবে, দুজনে বেশ পরামর্শ করে এসেছে। যদিও এসে দেখে এত সাবধানতার দরকার ছিল না। গোপা যেন ওদের পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছে।
ওদিকে কলেজে অঙ্কুরের নজর এড়িয়ে মিলি পলাশকে ডেকে নিয়ে যায় খেলার মাঠের এক কোণে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনে লিলির কথা। ও ভেবে নিয়েছে, বাড়িতে কিছুই বলবে না, অন্ততঃ পরীক্ষা পর্যন্ত তো বলবেই না। তবে সেধে যখন খবরটা ওর কাছে এসেছে, সবটা জানতে হবে।
পলাশের গতকালের কথা অনেকটাই মন দিয়ে শোনেনি মিলি। আজ মাথা ঠান্ডা রেখে শুনল। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে ফোন করল দিদিকে। লিলি তো বোনের ফোন পেয়ে খুব খুশি। প্রথমেই বলল, "সেই কবে একটুখানি দেখা করে গেলি, আর একবার ফোন করতে এতদিন? আমি ভয়ে করতে পারি না, বাবা মা, কে টের পাবে। এখনও দিদির উপর রাগ করে আছিস?"
- "এসব কথা বাদ দে দিদি, বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না। তুই আমাকে বল, রনিদার সঙ্গে তোর যোগাযোগ কবে থেকে?"
চলবে