Jharapata - 32 in Bengali Love Stories by Srabanti Ghosh books and stories PDF | ঝরাপাতা - 32

Featured Books
Categories
Share

ঝরাপাতা - 32

ঝরাপাতা

পর্ব - ৩২

❤💕❤💕❤💕❤

কলেজ থেকে ফিরে মিলি খবর পায়, পিউ এসে রবিবার সিনেমায় যাওয়ার দরবার করে গেছে। মায়ের আপত্তি তো নেই ই, ওকে বরং মিষ্টি করে বোঝাচ্ছে, "একটা দিন ঘুরে আয়। রোজ তো পড়াশোনা করিসই। তোরও ভালো লাগবে, আবার ওদের না বললে খারাপ ভাবতো।" যেন মিলি সিনেমা দেখতে গেলে সবাইকে উদ্ধার করে দেবে। হাসি চেপে হ্যাঁ বলে মিলি নিজের ঘরে পালিয়ে আসে। 

সেখানেও রনির নম্বর থেকে ফোন। ফোন ধরে দেখে, ওপাশে পিউ। রনি চেঁচামেচি করছে, সেও শোনা যাচ্ছে। পিউ প্রায় ধমক দিয়ে বলে, "এ্যাই ফোন কাটবি না। দিব্যি তো দুজন আড্ডা দিস। আর আমাদের বেলায়... শোন, রবিবার সকাল সকাল রেডি হয়ে যাবি। আমি নিজে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি, আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। মনে থাকে যেন।"

মিলি তাড়াতাড়ি বলে, "মা বলেছে, তুমি এসেছিলে। তোমার সঙ্গে বলেই যেতে বলেছে মা।"

- "হ্যাঁ সে আর বলতে! তুমি তো আর কারও সঙ্গে কোথাও যাও ন। এখন নতুন বন্ধু হয়েছে কেউ। সেইজন্য আজকাল তো আর পিউবৌদির সঙ্গে গল্পের সময়ই হয়না তোর। তাই প্ল্যানটা করা, বুঝলি?"

রনি এখানে আবার চেঁচাতে থাকে, "ফোনটা দাও না" বলে, পিউ এক দাবড়ানি দেয়, "চুপ করো তো, বলে ঘোরাতে নিয়ে যাচ্ছি!"

- "কি করব বলো? আমার শরীর খারাপ হয়ে সব গোলমাল হয়ে গেল। এখন কত পড়া জমে আছে। আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে, তার মধ্যেই তোমার সঙ্গে যাব বলে।" মিলি ওদিকে বলে যাচ্ছে। 

মিলির অসুস্থতার কথা উঠতেই রনি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে, পিউ খেয়াল করেছে। গতকাল বনির গোয়েন্দাগিরির পর আজ রনি আর মিলি, কেউ ফোন করার রিস্ক নেবে না, জানা কথা। মজা করতে ও নিজেই রনির ফোন কেড়ে নিয়ে ফোন করেছিল। ইচ্ছে ছিল, খানিকক্ষণ দুজনের লেগপুল করে ওদের কথা বলতে ছেড়ে দেবে। এখন না পরিবেশটা ভারী হয়ে যায়, তাড়াতাড়ি বলে, "অসুখ বিসুখ সবার হয়। তুই ওকথা ভুলে যা তো। এইটুকু একটা মেয়ে, কি সারাক্ষণ অসুখ অসুখ..... আর পড়াশোনা। পড়বি তো বটেই, তার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরা বেড়ানোও করতে হয়। চল দুজন আমাদের সঙ্গে ঘুরে আসবি। নে, তুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বল, আমি টুকাইকে দেখি।" রনিকে ফোন ধরিয়ে পিউ পালিয়ে যায়। যদিও এদের দুজনেরই ধারণা, পিউ আশেপাশেই থাকবে। রনিও কথা না বাড়িয়ে ফোন ছেড়ে দেয়, মিলিও কারণটা বোঝে। 

পরদিন কলেজে দেখা যায়, পলাশ বেশ খুশি খুশি। অন্য বন্ধুরাও জিজ্ঞেস করে, কি রে এত মুড ভালো? 

বিরাট ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে পলাশ। পাঠ্যবইয়ের ফলাও ব্যবসা ওর ঠাকুর্দার আমল থেকে। কলেজেই বন্ধুত্ব বাকিদের সঙ্গে। ওর স্কুলের দুই বন্ধু, সাগর আর আয়ুষ্মান কেবল এই কলেজে ওর সঙ্গে পড়ে। নতুন বন্ধুমহলেও পলাশ বেশ জনপ্রিয়, কারণ ওর দুহাত ভরা টাকা, যেকোনো সময় বেড়ানো, সিনেমার প্ল্যান করছে আর চুটিয়ে হইচই করছে। তবে মাঝে মাঝে বেশ মুড অফও থাকে। ওরকম একটা দিনেই সাগরের কাছে ওরা শুনেছে, পলাশের মা নেই। কয়েক বছর আগে হেপাটাইটিস এ চলে গেছেন। তারপর বাবা আবার বিয়েও করেছেন পরিবারের সকলের মতে। সেই মায়ের সঙ্গে যথারীতি সম্পর্ক ভালো নয় পলাশের। দুজনের তরফে মা আর ছেলের সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা দেখা যায়নি। বাড়িভর্তি কাজকর্মর লোকজন আছে বলে খাওয়া দাওয়া বা পরিষ্কার জামাকাপড় ওর জন্য ব্যবস্থা করাই থাকে। 

পলাশের বাবা নিজেই পছন্দ করে এই বিয়ে করলেও, মনের কোথাও ছেলের জন্যও মা আনছেন, এই ধারণা হয়ত ছিল। কার্যক্ষেত্রে পলাশ যেমন সরে থাকল, ওর নতুন মা অদিতিও পলাশের দিকে এগোলো না, বরং বিয়ের বছর ঘোরার সঙ্গে সঙ্গেই পলাশের বোনও এসে পড়ল। যার ফলে ওর বাবা চন্দনবাবুর সঙ্গেও ওর সম্পর্কটা স্রেফ নাম কা ওয়াস্তে হয়ে পড়ল। এই বোন আসার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই পলাশেরও যে গুরুত্ব আছে, এটা বোঝাতে ওর দুহাত টাকা পয়সা আর দামী উপহারে ভরে দিতে লাগলেন ওর বাবা। পলাশ সেটার সুবিধা ভোগ করে, তবে বাবার প্রতি মনোভাব খুব একটা বদলায় না। আর কখনো কোনো ছোটখাটো আবদারও যদি বাধা পায়, পলাশের মুড অফ চলতে থাকে। 

এহেন পলাশের আজকের খুশি ভাব কারও নজর এড়ায় না। পলাশ বন্ধুদের প্রশ্নে মিটিমিটি হাসে, "আছে আছে, কারণ আছে। দুটো দিন অপেক্ষা কর। বুঝবি, পলাশ সাহা কত বড় ম্যাজিশিয়ান। একটা তুড়ি বাজালে মানুষের ভাগ্য বদলে যায়।"

এই কথার পর বন্ধুরা আর ছাড়ে, কি ব্যাপার, কি হয়েছে, আরও আগ্রহ বেড়ে গেছে সবার। পলাশ কিন্তু শুধু একটা মাপা হাসি ধরে রেখেছে মুখে। কেউ জানতেই পারে না, কি হচ্ছে। 

মিলিও ছিল দলের মধ্যে। ওর ও জানার ইচ্ছে, পলাশ কিসের প্ল্যান করছে। তবে সময় নেই। ওকে যেতে হবে ডঃ গিরির কাছে। শনিবার, হাফ ডে কলেজ, তারপর বাবা মা চলে আসে। ওরা তিনজন যায় ওর থেরাপির জন্য। যেহেতু রনির সঙ্গে বাড়ি ফেরে না এই দিনটায়, অন্যান্য সপ্তাহের মতো আজও রনি একটা টেক্সট করেছে, "গুড লাক। বাড়ি ফিরে মেসেজ কোরো।" রনির এই কনসার্নে মন ভালো হয়ে যায়। তবে মিলি জানেনা, রনি গতকাল গোপনে ওর বাবার সঙ্গে দেখা করে টাকা দিয়ে গেছে। 

হাসিখুশি মিলি চেম্বারে ঢুকে গুড আফটারনুন বলতেই ডঃ গিরিরও ভালো লাগে। একটি একটি করে মানুষ জীবনের কাছে কখনো না কখনো পরাজিত হলেও তার হাত ধরে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে, উঠে দাঁড়িয়েছে, দেখলেই পরের পেশেন্টের সমস্যার সঙ্গে লড়াই করার জোর পেয়ে যান। 

আজও ওকে দেখে খুশিভরা মুখে বললেন, "ওয়েলকাম অদ্রিজা। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আর মধুমিতা বলছিল, তোমার কিছু কথা মনে পড়েছে। ভেরি গুড সাইন, আই থিঙ্ক। বোসো, দরকার হয় জল খাও, সময় নাও। ধীরে ধীরে বলো।"

চেম্বারের ভিতরের মিষ্টি ফুলের গন্ধের রুম ফ্রেশনারটা শ্বাসের সঙ্গে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে মাথার ভিতরেও। মিলি ভাবে, ভালো গান, সুরের সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধেরও বোধহয় মনের উদ্বেগ কমানোর একটা ক্ষমতা আছে। মনে পড়ে, হুঁ, আছেই তো, নানান রকম ন্যাচারাল এসেন্সিয়াল অয়েল আর এ্যারোমা ব্যবহার হয়, বডি ম্যাসাজে, স্ট্রেস রিলিভার হিসেবে। 

- "ম্যাডাম, এই রুম ফ্রেশনারটার নাম কি? খুব সুন্দর গন্ধ।" মিলি প্রথমে এটাই বলে। 

- "থ্যাংকস ফর ইওর কমপ্লিমেন্ট অদ্রিজা। এটা রুম ফ্রেশনার নয়। এটা একটা পাহাড়ি ফুলের গন্ধের কনসেনট্রেট। তুলোয় করে কাচের বাটিতে জলে ডোবানো আছে। জলে মিশে ধীরে ধীরে ছড়ায়। গন্ধটা শুধু সুন্দর নয়, রিভাইটালাইজিং বলতে পারো। এই গন্ধটা মনকে শান্ত করে। তোমার ভালো লাগলে আমি বলে দেব কোথায় পাওয়া যায়। ব্যবহার করতে পারো।"

মিলির মনে হয়, অনেকটা দাম হবে নিশ্চয়ই। থাক, আমার তো বিশেষ দরকার নয়। যদি ভালো রেজাল্ট করি, একটা ভালো চাকরি পাই তখন দেখা যাবে। এখন আবার একবার হেসে বলে, "ম্যাডাম, আমার কয়েকটা খটকা লাগছে। আমি মধুমিতা ম্যাডামকেও বলেছি," ঘাড় ঘুরিয়ে কোণাকুণি সোফায় বসা মধুমিতা আর সাবানা, ডঃ গিরির দুই এ্যাসিস্টেন্টের দিকেই তাকায় মিলি। দুজনেই মিষ্টি হাসে। 

ডঃ গিরিও ফোনের সমস্ত কথা শুনেছেন, ওদের বলাই আছে পেশেন্টের ফোনকল রেকর্ড করতে। তবে এখন সরাসরি শুনতে চান, মেলাতে চান, প্রায় চল্লিশ ঘন্টা সময়ে ওর ভাবনা কতটা এগিয়েছে। 

আর কেউ মুখ না খোলায় মিলি আবার শুরু করে, "আমার এমনিতে একটা খটকা লাগছিল, আমার সামনের বাড়ির ভদ্রলোক আমাকে তুমি করে বলছেন, কিন্তু মাঝে একদিন মনে হল, তুই বললেন। আর সেটা শুনে কেমন যেন মনে হল আগে আমাকে তুই ই বলতেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি বললে। চট করে অন্য কথায় চলে গেলেন।"

মিলির কাছে এসব কথা সমর আর গোপা আগে শোনেনি। দুজনেই ঘাবড়ে গেছে। মেয়ের দুপাশ থেকে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। মিলি বলে চলেছে, "তখন ঠিক খেয়াল হয়নি। পরে কেমন একটা গোলমাল লাগতে ম্যাডামকে ফোন করলাম। আসলে কি বলতেন, বা এখন কি বলছেন এটা নিয়ে ভাবছি না। এরকম মনে হচ্ছে কেন, এটাই আমার প্রশ্ন।"

- "ভেরি গুড," ডঃ গিরি জানেন, এই ভদ্রলোক অর্থাৎ শ্রেয়ান সরকারই আসল চরিত্র। চশমাটা ঠিক করতে করতে বললেন, "খুব ভালো পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, বলতে বাধ্য আমি। এখন ধরো জানা গেল, ভদ্রলোক তুমিই বলেন বরাবর। তাহলে তোমার দোষ নয় কিন্তু। আমাদের সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় কখনো কখনো হয় না, খুব জনপ্রিয় গানের শিল্পী বা বইয়ের লেখকের নাম ভুল হয়ে যায়। একটা সিনেমায় হিরোর নাম যা ছিল, সেটা অন্য সিনেমার নাম বলে মনে হয়। এরকম কখনো হয়নি আপনাদের সঙ্গে? কি মিঃ এ্যান্ড মিসেস করগুপ্ত?"

দুজনেই সিঁটিয়ে ছিলেন, এবার সমর তাড়াতাড়ি বলেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ। এ তো খুব হয়। এই তো সেদিন, ফেলুদার কোন কোন গল্পে গাওয়াঙ্গির কথা ছিল, একটা ক্যুইজ শোতে জিজ্ঞেস করল, কিছুতেই মনে পড়ল না।"

- "ঠিক বলেছেন। তাহলে বুঝতে পারছ অদ্রিজা? এছাড়াও কিছু কথা বলার আছে তোমার সঙ্গে। এক কাজ করি, শুধু আমরা তিনজন থাকি তোমার সঙ্গে? বাবা মা একটু অপেক্ষা করুন?"

ডঃ গিরি শ্রেয়ান সরকারের সম্পর্কে অদ্রিজার মনোভাব পুরোটাই জানা দরকার। শুরুতে বাবা মাকে কিছুটা শুনিয়ে নিশ্চিন্ত করে এবার আসল কথায় যাবেন। মিলি নিজেও কথা বলতে আগ্রহী, সে খুশিমনে ঘাড় কাত করল। 

চলবে