মিশন ইন্ডিয়ানা*************
পর্ব - 10
**********
The Team
***********
কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে একই দিকে চেয়ে থাকার পর দেবব্রত চৌধুরী এগিয়ে গেলেন সেই দিকে। বড় ঘরটার ঠিক মাঝখানে রাখা আছে একটা স্পেসক্রাফ্ট। আকারে বেশ বড়। দেখতে অনেকটা প্লেনের ককপিটের মত। প্লেনের ককপিটের মতই সামনের কাঁচের নিচের দিকটা ছুঁচলো। সব থেকে প্রথমে পাইলট এবং কো পাইলটের বসার জন্য দুটো সিট। তার পিছনে তিনটে, এবং তার পিছনে আরো তিনটে সিট। মানে মোট আট জনের বসার মত ব্যবস্থা আছে এই স্পেসক্রাফ্টে। স্পেসক্রাফ্ট জুড়ে মোট চারটে দরজা। পাইলট এবং কো পাইলটের পাশে দুটো এবং পিছনে দুটো। পিছনের দুটো দরজা উপর দিকে খোলে। পিছনের দিকে গোল মত স্পেসক্রাফ্ট এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বুস্টারের জায়গা বানানো আছে। পাইলটের সিটের সামনে এবং উপরের দিকে অজস্র বাটন। গোটা স্পেসক্রাফ্টটা ধূসর কালো রঙের। কোথাও-কোথাও আগুনের ঝলসানোর দাগ এখনো লেগে আছে। স্পেসক্রাফ্টের গায়ে লাল প্রতিফলিত রঙ দিয়ে বড়-বড় হরফে লেখা আছে - ইন্ডিয়ানা।
ধীর কদমে দেবব্রত এগিয়ে গেলেন সেই দিকে। তার চোখ, মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি যেন এই জগতেই নেই। হয়তো হারিয়ে গেছেন নিজের পুরোনো স্মৃতির ভিড়ে। এই ইন্ডিয়ানা করেই নিজের ক্রু নিয়ে এক দিন রওনা দিয়েছিলেন তিনি। ফিরে এসেছিলেন মনের মধ্যে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে। ইন্ডিয়ানা'র গায়ে হাত দিলেন দেবব্রত চৌধুরী। অজান্তেই তার দুটো চোখ ছলছল করে উঠলো। মৃত্যুঞ্জয় দেখলেন, দেবব্রত নিজের দুই হাত জড়ো করে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন স্পেসক্রাফ্ট ইন্ডিয়ানা'র সামনে।
********************************
'মে আই কামিং?'
অচেনা গলার আওয়াজ সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। তিনি এখন নিজের চেম্বারে বসে আছেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'প্লিজ।'
অনুরাগ বর্মন ভিতরে ঢুকে মৃত্যুঞ্জয়ের সামনের এক চেয়ারে বসে বললেন - 'আমি অনুরাগ, অনুরাগ বর্মন।'
'হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। নীহারিকা বলেছিল যে, আপনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য দেখা করতে চান আমার সঙ্গে।' মৃত্যুঞ্জয় বললেন।
'ঠিকই শুনেছেন। কিছু বলার আগে আমি শুধু এটা জানতে চাইবো যে, দেবব্রত কোথায় এখন?'
অনুরাগ বর্মনকে একবার ভালো করে দেখে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'আপাতত আমার চেম্বারে নেই, তবে আছেন ক্যাম্পাসের মধ্যেই।'
একটু চুপ থেকে অনুরাগ বর্মন বললেন - 'মিস্টার ভৌমিক, আপনি হয়তো জানেন যে, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ইন্ডিয়ানা নামের স্পেসক্রাফ্টের পাইলট ছিলাম আমি। দেবব্রত'র পর একমাত্র আমিই যে সেই মিশন থেকে জীবিত ফিরে এসেছিলাম। আমি কেমন পাইলট ছিলাম, সেটা আপনি দেবব্রতকে জিগ্যেস করতে পারেন।'
'সে সব তো ঠিক আছে অনুরাগ বাবু। কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান কেন, সেটা এখনো ক্লিয়ার হলো না। দেখুন মিস্টার বর্মন, আমার কাছে সময়ের খুব অভাব। অনেক কাজ পড়ে আছে।' নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন মৃত্যুঞ্জয়।
'মিস্টার ভৌমিক, আপনি এখন এখানকার চিফ। কেউ সহজে চিফ হয় না। আপনি চিফ হয়েছেন তার মানে আপনার অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার উপর প্রশ্ন করা মানে নিজের সময় নষ্ট করা। সেই অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার দরুণ আপনি এটা নিশ্চই বুঝতে পারছেন যে, ইসরোর ইস্ট্রান উইংএর আগামী মিশন খুব সহজ হবে না। এর আগের টাইটানের দুটো মিশন থেকেও ভয়ঙ্কর হতে পারে আগামী মিশন। সেক্ষেত্রে দেবব্রত চৌধুরীর সাথে কিছু ইয়াং এবং কম অভিজ্ঞতার টিম পাঠিয়ে আপনি কি বুদ্ধিমানের কাজ করছেন?'
অনুরাগ বর্মনের কথায় একটু চমকে গেলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। ঠিক কী বলতে চাইছেন উনি, মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলেন না। ভ্রুকুটি করে তাকালেন অনুরাগ বর্মনের দিকে। অনুরাগ আবার বললেন - 'এই মিশনের ডেঞ্জারের বিষয় একটু ভাবুন মিস্টার ভৌমিক। আমি শুধু আপনার ভালোর জন্য বলছি না, বলছি পুরো টিমের ভালো জন্য। ওখানে যদি আশানুরূপ কিছু না ঘটলো, তাহলে বেঁচে ফেরার উপায় কী? যেমন ভাবে দুবার আপনাদের স্পেসক্রাফ্ট ফিরে এসেছে, তৃতীয়বার তো নাও ফিরতে পারে।'
'আপনি বলতে কী চাইছেন? আর, তা ছাড়া উপায় কি আমাদের কাছে? যে টিম যাবে, তারা রীতিমতো দক্ষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।' মৃত্যুঞ্জয়ে বললেন।
'তাদের দক্ষতার উপর প্রশ্ন করছি না আমি মৃত্যুঞ্জয় বাবু। কিন্তু আপনি হয়তো এটা জানেন যে, মাঝে-মধ্যে দক্ষতার সাথে কপালের দরকারটাও পড়ে। চলুন আমি কপালে বিশ্বাসী হলাম না। কিন্তু সামনে থেকে যদি কোনো রকমের বিপদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সেই মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভাবনা-চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যায়। এটা একটা এমন বিপদ, যেখানে বিন্দুমাত্র ভুল হলে ফিরে আসার কোনো উপায় নেই। আপনার আ্যসট্রনটের বডিও ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।'
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'আমি সবই জানি মিস্টার বর্মন। কিন্তু আমি নিরুপায়। অনেক কষ্টে এই মিশনের পারমিশন পেয়েছি। যেহেতু এই মিশন ছাড়া কোনো উপায় নেই, তাই পারমিশন নেওয়া হয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু করা সম্ভব না। আর সম্ভব হলেও, কোনো উপায় নেই।'
অনুরাগ বর্মন নিজেকে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বললেন - 'উপায় আছে মিস্টার ভৌমিক, উপায় আছে।'
********************************
বারবার ক্লাস রুমে গিয়ে তনুশ্রীকে ডেকে আনা ভালো দেখায় না। তাই লাঞ্চ ব্রেক পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ঠিক করলো নীহারিকা। ক্লাস রুমের আশেপাশেই ছিল সে। দেড়টা সময় লাঞ্চ ব্রেক হয়। ঠিক সময়েই ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়ে এলো ক্লাস রুম থেকে। নীহারিকা দূর থেকে লক্ষ্য করলো, দেবরাজ বর্মন ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে অন্য দিকে চলে গেলেন। নীহারিকার দুটো চোখ ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়ের মধ্যে খুঁজছিল তনুশ্রীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তনুশ্রীকে খুঁজে পেল নীহারিকা। এগিয়ে গেল তনুশ্রীর দিকে। তনুশ্রীও তাকে দেখতে পেয়ে এগোলো। নীহারিকা চোখের ইশারায় তনুশ্রীকে পিছু নেওয়ার নির্দেশ দিলো। খানিক পরে দুজনেই মেন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো। বিল্ডিংএর বাঁ দিকে সুন্দর একটা বাগান বানানো আছে। গরমের দুপুরে এখানে মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বাগানের এক ধারে বড় এক শেডের নিচে সুন্দর ভাবে বসার জায়গা বানানো আছে। তনুশ্রীকে সেখানে বসার ইশারা করলো নীহারিকা।
'এখানে লোক কম। তাই কথা হতে পারে নিশ্চিন্তে।' বললো নীহারিকা।
নিজেও তনুশ্রীর পাশে বসলো। তনুশ্রী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নীহারিকার দিকে।
'তনুশ্রী, খুবই দরকারি কথা বলার জন্য এখানে নিয়ে এলাম তোমায়।'
'ইয়েস ম্যাম, বলুন।'
'তনুশ্রী, সেদিনের ডি-কোডিংটা তোমার মনে আছে?' নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
'হ্যাঁ ম্যাম।' ছোট্ট একটা উত্তর দিলো তনুশ্রী।
'কী বুঝেছিলে সেদিনের ডি-কোডিং দেখে?'
একটু ভেবে তনুশ্রী বললো - 'কেউ ম্যাসেজ করেছিল দেবব্রত স্যারকে। মে বি এলিয়েন। ম্যাম, সেদিনের পর থেকে আমি খুবই এক্সসাইটেড। এই এক্সাইটমেন্টের কারণটা যদিও বুঝতে পারছি না।'
'তনুশ্রী, তোমায় সেদিনও বলেছিলাম, আজও বলছি, এ বিষয়ে কারোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করবে না।'
'ইয়েস ম্যাম। মনে আছে। এমন কি নিজের বাড়িতেও বলিনি আমি।'
'গুড। তনুশ্রী, এখন যে কথাটা বলবো তোমায়, সেটা খুবই ইম্পর্টেন্ট। তুমি যদি এগ্রি হয়ে যাও, তাহলে তোমার লাইফ চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।'
'কী ম্যাম?'
আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে নীহারিকা বললো - 'তনুশ্রী, আমরা একটা মিশনে যাচ্ছি। যেখান থেকে সেই ম্যাসেজটা এসেছিল, সেখানে। আমাদের দেশকে, হয়তো সমস্ত পৃথিবীকে এক ভয়ানক সংকটের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা এটা। এর আগে আমি যতগুলো মিশন করেছি ক্যাপ্টেন হিসেবে, সব গুলোতে আমার সঙ্গে অর্ণব ছিল। অর্ণব কো পাইলট ছাড়া ছিল ডি-কোডিং এক্সপার্ট। অর্ণব এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। এই মিশনে আমাদের এমন একজনকে প্রয়োজন যে লেটেস্ট কমিউনিকেশন স্কিলে এক্সপার্ট হোক। আমরা তোমার ডি-কোডিং স্কিল দেখেছি তনুশ্রী। উই আর ইমপ্রেস্ড। তোমার ডি-কোডিং স্কিলের প্রশংসা দেবব্রত চৌধুরী এবং চিফ মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকও করেছেন। তনুশ্রী, আমাদের এই মিশনের জন্য তোমাকে দরকার।'
নীহারিকার কথায় তনুশ্রীর মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। নিজের উত্তেজনাকে চেপে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য।
'আই আ্যম অলওয়েজ রেডি ম্যাম। আপনার সঙ্গে মিশনে যাওয়াটা যে আমার বহু দিনের স্বপ্ন।' উৎসাহিত হয়ে তনুশ্রী বললো।
'তোমার উৎসাহ দেখে ভালো লাগলো তনুশ্রী। কিন্তু একটা মিশনে যাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার। তার জন্য খুবই কঠিন ট্রেনিং পাস করতে হয়। আমি তোমায় ভয় দেখাচ্ছি না তনুশ্রী। যেটা ফ্যাক্ট সেটাই বলছি। পৃথিবীর গ্রাভিটির বিপরীতে যখন কোনো স্পেসক্রাফ্ট মহাকাশের দিকে এগিয়ে যায়, সেই সময় স্পেসক্রাফ্টের ভিতরে বসে থাকা কোনো দুঃস্বপ্নের থেকে কিছু কম না। আ্যটমোসফিয়ার পেরিয়ে যেতে হবে। শুধু পৃথিবীর আ্যটমোসফিয়ার নয়, টাইটানের আ্যটমোসফিয়ারও আছে, যেটা পৃথিবীর আ্যটমোসফিয়ার থেকে বেশি ঘন। তনুশ্রী, তুমি এখন স্টুডেন্ট। সবে মাত্র জয়েন করেছো। আমি জানি তোমায় প্রপোজাল দেওয়াটা আমার অন্যায় হচ্ছে। বিশ্বাস করো, তোমার মত ডি-কোডিং এক্সপার্ট যদি অন্য কাউকে পেতাম, তাহলে তোমায় বলতাম না।'
তনুশ্রী মন দিয়ে নীহারিকার কথা গুলো শুনছিলো।
'নো প্রব্লেম ম্যাম। আমি তো বললাম আপনাকে, আই আ্যম অলওয়েজ রেডি। যদি ট্রেনিং নিতে হয়, তাহলে নেবো আমি। এমনিতেও তো কিছু মাস পর থেকে আমাদের প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং শুরু হবে। যেটা কিছু মাস পরে হবে, সেটা কিছু মাস আগে হলে ক্ষতি কী?'
********************************
লঞ্চ প্যাডের বাঁ দিকে বিশাল "ইঞ্জিনিয়ার্স রুম" অবস্থিত। ইসরোর ইস্ট্রান উইংএর ইঞ্জিনিয়াররা প্রতিনিয়ত এখানে কাজ করে চলেছে। নতুন স্যাটেলাইটের গবেষণা অথবা সেটা তৈরির বিষয় নানা রকমের কাজ এখানেই হয়। বেশ কিছু রকেট এবং স্পেসক্রাফ্টও রাখা আছে সেখানে। কিছু স্পেসক্রাফ্ট এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি এবং কিছু তৈরি হয়ে মহাকাশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। দেবব্রত চৌধুরী জায়গাটা ঘুরে দেখছিলেন। বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ারের সাথে একটু আগেই পরিচয় হলো তার। সপ্তর্ষি, অরিজিৎ এবং অম্লান সেখানেই ছিল। দেবব্রত কে দেখে এগিয়ে এলো তারা।
'স্যার আসুন, আপনাকে কিছু দেখাই।' সপ্তর্ষি দেবব্রত চৌধুরীকে নিজের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার্স রুমের আরো ভিতরে নিয়ে গেল। দেবব্রত দেখলেন এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বেশ বড় রকম একটা স্পেসক্রাফ্ট। দেখতে অনেকটা ইন্ডিয়ানা'র মতই। কালো রঙের বর্ডার দেওয়া সাদা গায়ের রঙ। কালো প্রতিফলিত রঙ দিয়েই বড়-বড় করে লেখা আছে - আই এস এস, ইম্পেরিয়াল। দেবব্রত চৌধুরীর দেখে মনে হলো আই এস এস, ইম্পেরিয়াল একটু হলেও ইন্ডিয়ানা'র থেকে বড়।
'এটা লেটেস্ট। আমরা যেই স্পেসক্রাফ্টে গিয়েছিলাম সেটার নাম ছিল, ভ্যালিয়েন্ট। আমাদের রওনা দেওয়ার কিছু দিন পরেই এটা তৈরি হলো। ভ্যালিয়েন্টে পাইলট আর কো পাইলট মিলিয়ে মোট দশ জন ক্রু মেম্বারের বসার জায়গা ছিল। এটাকে একটু বড় করেছে। মোট বারো জন ক্রু মেম্বার বসতে পারে।' স্পেসক্রাফ্টের দিকে এগিয়ে সপ্তর্ষি বললো।
স্পেসক্রাফ্টটা মাটি থেকে একটু উপরে রাখা ছিল। সপ্তর্ষির সাথে দেবব্রত চৌধুরীও ছয়টা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখলেন নতুন স্পেসক্রাফ্ট কে। বেশ আধুনিক বলেই মনে হলো তার। এই নতুন স্পেসক্রাফ্টে দরজা ছয়টা। পিছনের চারটে দরজা উপর দিকে খোলে। বুস্টারের গোল জায়গাটাও বেশ বড়।
'এর স্পিড ভ্যালিয়েন্ট থেকে বেশি। ভ্যালিয়েন্ট করে আমাদের টাইটান পর্যন্ত পৌঁছতে ষাট দিন লেগেছিল। এতে আরো কম সময় লাগবে।' সপ্তর্ষি বললো।
'তাহলে কি আমরা এতে করে যাবো?' প্রশ্ন করলেন দেবব্রত।
'মোস্ট প্রব্যাবলি। আ্যটমোসফিয়ারিক হিট কে সহ্য করার ক্ষমতাও এটার বেশি। এই স্পেসক্রাফ্টটা বেসিক্যালি এমন প্ল্যানেটের জন্য বানানো হয়েছে, যেখানে আ্যটমোসফিয়ারের ঘনত্ব পৃথিবীর থেকে বেশি। যেমন, টাইটান।' নিজের কথা শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো সপ্তর্ষি। দেবব্রতও নেমে এলেন নিচে।
'ফ্যান্টাস্টিক। বিজ্ঞানের এহেন উন্নতিই তো দরকার। তবে আমাদের ইন্ডিয়ানাও কিছু কম ছিল না। তুমি বললে তোমাদের ভ্যালিয়েন্ট ষাট দিন লাগিয়েছিল টাইটান পৌঁছতে। আমরা ইন্ডিয়ানা করে সত্তর দিনে টাইটান পৌঁছেছিলাম। তাও আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। এবার দেখা যাক, এটা আমাদের কত দিনে নিয়ে যায়।' দেবব্রত বললেন এবং সপ্তর্ষির সঙ্গে হাঁটতে থাকলেন।
হঠাৎ সপ্তর্ষির মোবাইলে রিং হলো। নীহারিকা কল করেছে।
'দেবব্রত স্যার কি তোর সঙ্গে আছেন?' নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
'হ্যাঁ।' জবাব দিলো সপ্তর্ষি।
'তোরা যেখানেই আছিস ইমিডিয়েট মেন কন্ট্রোল রুমে চলে আয়।'
'কেন? কী হলো?' উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলো সপ্তর্ষি।
'ম্যাসেজ।' নীহারিকা কল কেটে দিলো।
********************************
মেন কন্ট্রোল রুমে শিল্পী দুবে কে ঘিরে আবার সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে উপস্থিত আছে তনুশ্রীও। কন্ট্রোল রুমের দরজা খুলে ভিতর ঢুকলো সপ্তর্ষি এবং দেবব্রত চৌধুরী। দুজনেই বেশ হাঁফাচ্ছ। দেখেই মনে হচ্ছে বেশ ছুটেই এসেছে তারা। রুমে ঢুকেই অনুরাগ বর্মনকে দেখে আশ্চার্য হলেন দেবব্রত চৌধুরী।
'তুমি এখানে?' অবাক হয়ে অনুরাগ বর্মনকে জিজ্ঞাসা করলেন দেবব্রত।
'এখন এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় নেই দেবব্রত। মনিটারে নতুন ম্যাসেজ ফুটে উঠেছে।' অনুরাগ বর্মন বললেন।
দেবব্রত মনিটারের দিকে এগিয়ে গেলেন। মনিটারের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে তনুশ্রী। ডি-কোডিংএ ব্যস্ত সে।
'কখন এসেছে ম্যাসেজ?' দেবব্রত জিজ্ঞাসা করলেন মৃত্যুঞ্জয়কে।
'একটু আগে। প্রায় আধ ঘন্টা আগে।' উত্তর দিলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক।
বিপ-বিপের কিছু শব্দে সামনের মনিটারে ভেসে উঠছে অত্যাধুনিক মোর্স কোডে কিছু ম্যাসেজ।
'কিছু বুঝতে পারছো তনুশ্রী?' প্ৰশ্নটা নীহারিকা করলো তনুশ্রীকে।
প্রায় পাঁচ-ছয় সেকেন্ড পর তনুশ্রী ভালো করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো - 'প্রথম ম্যাসেজে লেখা আছে, হাউ মাচ? দ্বিতীয় ম্যাসেজে লেখা আছে, উই হ্যাভ নট এনাফ টাইম।'
সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। এর জবাব কী দেবে সেটা এই মুহূর্তে কেউ বুঝতে পারছে না।
'আমাদের কম করেও একমাস সময় চাওয়া উচিত।' বললো নীহারিকা।
নীহারিকার কথায় চমকে গেলেন মৃত্যুঞ্জয়।
'এক মাস! নীহারিকা, আর ইউ অল রাইট? তোমার কি মনে হয় তারা এক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?' মৃত্যুঞ্জয় বললেন।
'স্যার, আমি বলছি তার পিছনে কারণ আছে।' কথা বলে নীহারিকা তাকালো তনুশ্রীর দিকে।
'কী কারণ?' মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলেন।
'স্যার, আমাদের ডি-কোডিং করার একজনকে লাগবে। এটা ভুললে চলবে না যে, অর্ণব আর নেই।'
মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলেন নীহারিকা ঠিক কী বলতে চাইছে।
'নীহারিকা, আর ইউ ম্যাড? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোমার মনে হয় যে, এক মাসের মধ্যে তুমি একে ট্রেন্ড করতে পারবে?' মৃত্যুঞ্জয়ের গলার আওয়াজ উচ্চ হচ্ছিল।
'আমাদের কাছে আর কোনো উপায় নেই স্যার। তনুশ্রী না গেলে এতো দূরে গিয়ে তাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করা সম্ভব হবে না। যাওয়াটাই বেকার হবে আমাদের।'
নীহারিকার কথায় চুপ হলেন মৃত্যুঞ্জয়।
'আমার কাছে একটা উপায় আছে। আমরা তনুশ্রীকে না নিয়ে গিয়ে যদি এখানে কাউকে লেটেস্ট কোডের ট্রেনিং দেওয়া হয়। আমাদের মধ্যে কাউকে। না হয় তনুশ্রী নিজেই শিখিয়ে দেবে। এটা করলে তো আর বেশি সময় লাগবে না, আর রিস্ক ফ্যাক্টরও থাকবে না।' সপ্তর্ষি এগিয়ে এসে বললো।
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতার পর দেবব্রত তনুশ্রীকে বললেন - 'তনুশ্রী, এক মাস লিখে দাও।'
ক্রমশঃ....