Even after the silence, you in Bengali Love Stories by Md Mottakin books and stories PDF | নীরবতার পরেও তুমি

Featured Books
Categories
Share

নীরবতার পরেও তুমি

📖 অধ্যায় ১
চোখের ভাষায় প্রথম নীরবতা
শহরের বিকেলগুলো সব সময় একটু ক্লান্ত থাকে।
ধুলো, শব্দ আর মানুষের ভিড়—সব মিলিয়ে যেন প্রতিদিনই কারও না কারও মন ভেঙে পড়ে।
আর সেই বিকেলেই প্রথম দেখা হয়েছিল আরিয়ান আর নীরার।
আরিয়ান কথা কম বলে। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও তার অস্বস্তি হয়। সে বিশ্বাস করে—সব অনুভূতির ভাষা শব্দে হয় না। কিছু অনুভূতি থাকে, যেগুলো চুপচাপ বুকের ভেতরেই ভালো থাকে।
নীরা ঠিক তার উল্টো। খুব বেশি কথা বলে না, কিন্তু তার চোখ—সেগুলো কথা বলে ফেলে অজান্তেই। নিজের অজান্তেই।
সেদিন বাসস্ট্যান্ডে দু’জনের দেখা। কোনো সিনেমার দৃশ্যের মতো কিছুই ছিল না। না ধাক্কা, না স্লো-মোশন মুহূর্ত।
শুধু এক মুহূর্তের চোখাচোখি।
আরিয়ান লক্ষ্য করেছিল—নীরা তাকিয়ে ছিল না, তবু চোখ সরানোর আগেই যেন বুঝে ফেলেছিল কেউ তাকে দেখছে।
এই বুঝে ফেলার মধ্যেই কিছু একটা বদলে যায়।
নীরা চোখ তুলে তাকিয়েছিল।
একদম ক্ষণিকের জন্য।
কিন্তু সেই ক্ষণিকেই যেন সময় থমকে গিয়েছিল।
“এই মানুষটাকে আমি চিনি না…
কিন্তু অচেনাও লাগছে না কেন?”
নীরা নিজের মনে প্রশ্ন করেছিল।
আরিয়ান চোখ সরিয়ে নিয়েছিল আগে।
সে জানত না কেন, কিন্তু মনে হয়েছিল—আর বেশি তাকালে কিছু ভেঙে যাবে।
বাস আসে।
মানুষ ওঠে, নামে।
দু’জন একই বাসে উঠে পড়ে—এটাও কাকতাল নয়, আবার গল্পের জোর করা ঘটনাও নয়।
শহরে এমন হতেই পারে।
বাসের ভেতরে তারা পাশাপাশি দাঁড়ায়নি।
দূরে ছিল।
তবু খুব কাছাকাছি।
আরিয়ান জানালার কাঁচে নিজের প্রতিফলনের পাশে নীরার ছায়া দেখতে পাচ্ছিল।
নীরা দেখছিল—ছেলেটা অকারণে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে, অথচ চোখে কোথাও না কোথাও একটা গভীরতা।
কেউ কারও সাথে কথা বলেনি।
কিন্তু নীরবতার মধ্যেই যেন একটা অদ্ভুত পরিচয় তৈরি হচ্ছিল।
বাস থেকে নামার সময় নীরা একটু থেমে গিয়েছিল।
হয়তো চেয়েছিল কিছু একটা বলবে।
হয়তো শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছিল—এই নীরবতাটা একতরফা নয়।
আরিয়ান তখনো কিছু বলেনি।
শুধু একবার তাকিয়েছিল।
সেই তাকানোতে কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।
ছিল না ভালোবাসার ঘোষণা।
ছিল শুধু—
একটা শুরু।
যে শুরু শব্দে নয়,
চোখের ভাষায়।
📖 অধ্যায় ২
অচেনা অভ্যাসের শুরু
কিছু মানুষ জীবনে আসে—
ঘটনার মতো নয়,
অভ্যাসের মতো।
আরিয়ান বুঝতেই পারেনি, কখন নীরার অস্তিত্ব তার দিনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
পরের কয়েকদিন সে নিজের প্রতিদিনের রুটিনে একধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করছিল। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকলে অজান্তেই চোখ দুটো ভিড় ছেঁটে খুঁজে বেড়াতো কাউকে। কাউকে মানে—একটি নির্দিষ্ট মুখ, একটি নির্দিষ্ট চোখ।
“এটা কি কৌতূহল?”
“না কি শুধু কাকতালীয় স্মৃতি?”
আরিয়ান নিজেকেই প্রশ্ন করত।
কিন্তু উত্তর খুঁজত না।
কারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর না থাকাই নিরাপদ।
নীরার দিনগুলোও খুব আলাদা ছিল না।
সে আগের মতোই অফিসে যেত, কাজে ডুবে থাকত, ক্লান্ত সন্ধ্যায় ফিরত।
তবু মাঝেমধ্যে হঠাৎ মনে হতো—
কেউ একজন যেন তার দিনের ফাঁকে ফাঁকে চুপচাপ বসে আছে।
সে বুঝতে পারত না কেন,
বাসে উঠলেই চোখ আপনা-আপনি জানালার দিকে চলে যেত।
একদিন হঠাৎ আবার দেখা।
এবার আর কাকতাল বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকান।
ভিড় কম।
বিকেলের আলো একটু নরম।
আরিয়ান আগে এসেছিল। চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
নীরা আসতেই সে বুঝে গেল—এই হাঁটার ভঙ্গি, এই থেমে থেমে তাকানো—ভুল হওয়ার নয়।
নীরা তাকিয়ে দেখল।
এইবার চোখ সরায়নি।
একটু থামল।
আরিয়ানও।
দু’জনের মাঝখানে কয়েক কদম দূরত্ব।
কিন্তু সেই দূরত্বে কোনো অস্বস্তি নেই।
নীরা ধীরে বলল,
— “আপনি… আগেও একদিন বাসে ছিলেন, তাই না?”
কণ্ঠে দ্বিধা ছিল,
কিন্তু ভয় ছিল না।
আরিয়ান প্রথমে একটু অবাক হলো।
তারপর মাথা নেড়ে বলল,
— “হ্যাঁ… মনে হয় তাই।”
এই “মনে হয়”-এর ভেতরে লুকিয়ে ছিল অনেক নিশ্চিত অনুভূতি,
যেগুলো সে শব্দে আনতে চায়নি।
চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছিল।
নীরবতা ছিল,
কিন্তু আগের মতো ভারী নয়।
— “আপনি খুব চুপচাপ থাকেন,”
নীরা বলল হঠাৎ।
আরিয়ান হালকা হাসল।
— “চুপ থাকলে মানুষকে বেশি বোঝা যায়।”
নীরা আর কিছু বলল না।
কিন্তু তার চোখে একধরনের প্রশান্তি ফুটে উঠল।
সেদিন তারা খুব বেশি কথা বলেনি।
নাম জানেনি।
কোথায় কাজ করে, সেটাও না।
তবু আলাদা হওয়ার সময় নীরা বুঝতে পেরেছিল—
আজকের দিনটা আর অন্য দিনের মতো থাকবে না।
আরিয়ানও জানত,
আজ থেকে বাসস্ট্যান্ডটা আর শুধুই বাসের জায়গা নয়।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আরিয়ান খেয়াল করল—
সে বারবার সেই কথোপকথনের ভেতর ফিরে যাচ্ছে।
“আপনি খুব চুপচাপ থাকেন।”
এই একটি বাক্য যেন অদ্ভুতভাবে তার মনে জায়গা করে নিয়েছে।
নীরার ঘরেও আলো জ্বলছিল।
সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়েছিল।
নিজের অজান্তেই মনে হলো—
কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয় কথা দিয়ে,
আর কিছু মানুষের সাথে—
নীরবতার ভেতর দিয়েই।
আর সেই নীরবতা থেকেই জন্ম নেয়
অচেনা অভ্যাস।
যার নাম তখনো কেউ জানে না।
📖 অধ্যায় ৩
কথা না বলেও যে কাছাকাছি
কিছু সম্পর্কের শুরুতে প্রশ্ন থাকে না।
থাকে শুধু—একটা স্বস্তিকর উপস্থিতি।
আরিয়ান আর নীরার মধ্যেও ঠিক সেটাই জন্ম নিচ্ছিল।
তারা নিয়ম করে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়নি।
কিন্তু তবু সপ্তাহে দুই-তিন দিন দেখা হয়ে যেত।
বাসস্ট্যান্ডে, চায়ের দোকানে, কখনো কখনো কেবল রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মুহূর্তের জন্য।
কথা খুব বেশি হতো না।
কিন্তু যতটুকু হতো, তাতেই দিনের ক্লান্তি কিছুটা হালকা হয়ে যেত।
আরিয়ান লক্ষ্য করত—নীরা কথা বলার সময় চোখে চোখ রাখে,
আবার নিজের অজান্তেই দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।
যেন সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না, কতটা কাছে আসতে চায়।
নীরা দেখত—আরিয়ান কথা কম বললেও শোনে মন দিয়ে।
তার নীরবতার মধ্যে কোনো শূন্যতা নেই,
বরং আছে একধরনের স্থিরতা।
একদিন বাসে পাশাপাশি বসার সুযোগ হলো।
কাকতাল বলেই মনে হলো দু’জনেরই।
বাসের ভেতর হালকা অন্ধকার।
জানালার বাইরে শহর ছুটে চলেছে।
নীরা জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল।
আরিয়ান তাকিয়ে ছিল—নীরার মুখের পাশে পড়া আলো-ছায়ার দিকে।
— “আপনি কি কখনো ভয় পান?”
নীরা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
প্রশ্নটা হালকা ছিল না।
কিন্তু বলার ভঙ্গিটা ছিল একেবারে সাধারণ।
আরিয়ান একটু ভেবে বলল,
— “পাই… তবে সেটা হারানোর ভয় না।
বরং পাওয়ার পর বদলে যাওয়ার ভয়।”
নীরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর ধীরে বলল,
— “আমি ভয় পাই, মানুষ আমাকে ভুল বুঝবে।”
এই প্রথম তারা নিজেদের ভেতরের কথা ছুঁয়ে দেখল।
খুব গভীরে না গিয়েও।
বাস থামল।
নীরাকে নামতে হবে।
সে দাঁড়ানোর সময় একটু দুলে পড়েছিল।
আরিয়ান হাত বাড়ায়নি।
শুধু খুব কাছ থেকে বলেছিল,
— “ধীরে।”
এই একটিমাত্র শব্দে এতটা যত্ন ছিল,
নীরা অবাক হয়ে গিয়েছিল।
নামার সময় সে একবার ফিরে তাকিয়েছিল।
আরিয়ান তখনো তাকিয়ে ছিল।
সেই তাকানোতে কোনো দাবি ছিল না।
ছিল না অধিকার।
ছিল শুধু—
একটা নীরব আশ্বাস।
যে কেউ কাউকে জোর করে কাছে টানছে না।
তবু কাছাকাছি আসা থেমে থাকছে না।
সেদিন রাতে নীরা ঘুমাতে পারেনি।
বারবার মনে পড়ছিল সেই “ধীরে” বলা কণ্ঠটা।
আরিয়ান জানালার পাশে বসে ছিল।
বাইরে অন্ধকার।
ভেতরে একধরনের আলো।
“এটা কি শুরু?”
সে নিজেকে প্রশ্ন করেনি।
কারণ সে জানত—
যে সম্পর্ক প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয় না,
তা উত্তর চেয়েও থামে না।
কিছু মানুষ কথা না বলেও
খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।
আর সেই কাছাকাছিই
সবচেয়ে গভীর অনুভূতির জন্ম দেয়।
📖 অধ্যায় ৪
শহরের ভিড়ে দু’টি আলাদা মন
শহর কাউকে একা থাকতে দেয় না।
আবার কাউকে সত্যিকার অর্থে আপনও করে না।
আরিয়ান এই শহরে বহুদিন ধরে আছে।
কাজ, বাসা, পথ—সব চেনা।
তবু তার জীবনে কেউ নেই, যাকে দিনের শেষে সব কথা বলা যায়।
সে অফিস থেকে ফিরলে জানালা খুলে বসে থাকে।
রাস্তায় মানুষের যাতায়াত দেখে।
এই শহরে এত মানুষ,
তবু কারও সাথে তার জীবনের ছন্দ মেলে না—এই ভেবে মাঝে মাঝে অবাক হয়।
নীরার জীবন বাইরে থেকে বেশ গোছানো।
একটা স্থির চাকরি, পরিচ্ছন্ন ছোট ফ্ল্যাট, সময়মতো ঘুম।
কিন্তু দিনের শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করে—
“আমি কি ঠিক আছি,
না কি শুধু ঠিক থাকার অভিনয় করছি?”
তার বন্ধুরা বলে,
— “তুই খুব শক্ত।”
নীরা হাসে।
কারণ সে জানে, শক্ত হওয়া আর একা থাকা অনেক সময় একই জিনিস হয়ে যায়।
এক সন্ধ্যায় হঠাৎ দেখা হয়ে যায় দু’জনের।
বৃষ্টি পড়ছিল।
হালকা, থেমে থেমে।
চায়ের দোকানে ভিড় ছিল।
তারা আলাদা আলাদা টেবিলে দাঁড়িয়েছিল।
আরিয়ান প্রথম দেখতে পায়।
নীরাকে ডাকে না।
শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
নীরা বুঝে ফেলে।
এই বুঝে ফেলার একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে তার।
সে এগিয়ে আসে।
— “বৃষ্টি নামলেই শহরটা আলাদা লাগে,”
নীরা বলে।
আরিয়ান মাথা নেড়ে বলে,
— “হ্যাঁ… তখন ভিড়ের শব্দ কম শোনা যায়।”
দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখে।
কথা থেমে থেমে আসে।
নীরা হঠাৎ বলে,
— “এই শহরে সবাই খুব ব্যস্ত, তাই না?”
আরিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর বলে,
— “ব্যস্ত না হলে হয়তো একা লাগবে আরও বেশি।”
নীরা তাকায় তার দিকে।
এই কথার ভেতরে নিজেকে খুঁজে পায়।
বৃষ্টি একটু জোরে নামে।
চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে আসে।
এই প্রথম তাদের নীরবতায় একটা হালকা ভারী অনুভূতি ঢুকে পড়ে।
যেন তারা দু’জনেই বুঝতে পারছে—
কেউ কাউকে ঠিক করে চেনে না,
তবু খুব কাছ থেকে কিছু একটা অনুভব করছে।
বিদায় নেওয়ার সময় নীরা বলে,
— “আপনি… কখনো কখনো থাকবেন তো?”
প্রশ্নটা খুব সাধারণ।
কিন্তু আরিয়ানের বুকের ভেতরে হালকা কাঁপন তুলে দেয়।
সে শুধু বলে,
— “থাকব।”
এই “থাকব”-এর মধ্যে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই।
তবু আছে—একটা আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি।
শহরের ভিড়ের ভেতর
দু’টি আলাদা মন
ধীরে ধীরে একে অপরের শব্দ চিনে নিতে শুরু করে।
📖 অধ্যায় ৫
না বলা প্রশ্ন, না চাওয়া উত্তর
কিছু প্রশ্ন থাকে,
যেগুলো উচ্চারণ করলে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আরিয়ান আর নীরা—দু’জনেই সেটা বুঝত।
তাদের দেখা এখন প্রায় নিয়মিত।
কখনো বাসস্ট্যান্ডে, কখনো অফিস ফেরত পথে, কখনো শুধু হেঁটে চলার সময়।
তারা কেউ কাউকে ডাকত না,
তবু ঠিকই এসে দাঁড়াত এক জায়গায়।
এই আসা-যাওয়ার ভেতর কোনো চুক্তি ছিল না।
ছিল শুধু একধরনের নীরব বোঝাপড়া।
এক সন্ধ্যায় তারা হাঁটছিল ফুটপাথ ধরে।
শহরের আলো জ্বলছে।
মানুষের ভিড়—কিন্তু দু’জনের মাঝখানে একধরনের শান্ত ফাঁকা জায়গা।
নীরা হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়।
— “আপনি কি কখনো কাউকে খুব চেয়েছেন?”
সে জিজ্ঞেস করে।
প্রশ্নটা হঠাৎ হলেও কণ্ঠে কোনো চাপ ছিল না।
যেন উত্তর না পেলেও ক্ষতি নেই।
আরিয়ান হাঁটা থামায়।
চোখ নামিয়ে বলে,
— “চেয়েছি… কিন্তু বলিনি।”
নীরা মৃদু হাসে।
— “আমিও।”
এই ‘আমিও’—এর ভেতরে তারা দু’জনেই অনেক কিছু খুঁজে পায়।
কিন্তু কেউ কিছু খুলে বলে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর নীরা বলে,
— “মানুষ কেন নিজের অনুভূতিগুলো এত লুকায়?”
আরিয়ান একটু ভেবে বলে,
— “হয়তো এই ভয়ে—যদি কেউ সেটা ঠিকভাবে ধরে রাখতে না পারে।”
নীরা কিছু বলে না।
শুধু বুঝে নেয়—এই মানুষটা যতটা নীরব, ততটাই ভঙ্গুর।
তাদের চোখে চোখ পড়ে।
এইবার দীর্ঘ সময়ের জন্য।
কেউ সরে যায় না।
কিন্তু সেই তাকানোর ভেতরেও কোনো দাবি নেই।
শুধু প্রশ্ন—
তুমি কি বুঝছো, আমি কী বলতে চাই?
আর তার পাশাপাশি আরেকটা প্রশ্ন—
যদি বুঝো, তবে কি বদলে যাবে সবকিছু?
বিদায় নেওয়ার সময় নীরা একটু থেমে বলে,
— “কখনো কখনো মনে হয়… কিছু না জেনেই থাকা সহজ।”
আরিয়ান মাথা নেড়ে বলে,
— “হ্যাঁ। কারণ উত্তর পেলে দায়িত্ব এসে যায়।”
এই কথার পর তারা আর কিছু বলে না।
নীরা বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবে—
সে কি সত্যিই কিছু জানতে চায়?
নাকি শুধু এই অজানা অবস্থাটুকু ধরে রাখতে চায়?
আরিয়ান জানালার পাশে বসে থাকে।
রাত গভীর।
শহর ধীরে চুপ করছে।
তার মনে হয়—
ভালোবাসা হয়তো সবসময় উচ্চস্বরে আসে না।
কখনো কখনো তা আসে
না বলা প্রশ্নের আড়ালে,
না চাওয়া উত্তরের ভেতর দিয়ে।
আর সেই না বলা-না চাওয়ার মাঝখানেই
সবচেয়ে গভীর অনুভূতিগুলো
নীরবে বেঁচে থাকে।
📖 অধ্যায় ৬
অপেক্ষা নামের অদৃশ্য সম্পর্ক
অপেক্ষা সবসময় কাউকে ক্লান্ত করে না।
কখনো কখনো অপেক্ষাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
আরিয়ান আর নীরার সম্পর্ক এখন ঠিক এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে,
যেখানে কিছু না ঘটলেও অনেক কিছু চলতে থাকে।
তারা এখন আর প্রতিদিন দেখা করে না।
কিন্তু দিনের কোনো এক সময়—
একজন অন্যজনের কথা ভেবে নেয়।
আরিয়ান অফিসে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎ থেমে যায়।
কোনো কারণ ছাড়াই মনে হয়—
নীরা হয়তো আজ একটু ক্লান্ত।
এই ভাবনার কোনো প্রমাণ নেই।
তবু সে বিশ্বাস করে।
নীরাও ঠিক তেমনই।
বাসে জানালার পাশে বসে হঠাৎ মনে হয়—
আরিয়ান আজ নিশ্চয়ই কম কথা বলেছে।
এই শহরে কেউ কি সেটা খেয়াল করে?
সে জানে না কেন,
কিন্তু এই ভাবনাগুলো তাকে একা থাকতে দেয় না।
একদিন হঠাৎ অনেকদিন পর দেখা হয়ে যায়।
কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই।
চেনা রাস্তার মোড়ে।
নীরা একটু অবাক হয়।
আরিয়ানও।
কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলে না।
তারপর নীরা বলে,
— “অনেকদিন দেখা হয়নি।”
আরিয়ান মাথা নেড়ে বলে,
— “হ্যাঁ… কিন্তু অচেনা লাগছে না।”
এই কথাটুকুতেই নীরার চোখে একধরনের কোমলতা এসে যায়।
সে বোঝে—এই মানুষটা দূরে থেকেও কাছেই ছিল।
তারা পাশাপাশি হাঁটে।
আগের মতোই।
কিন্তু আজ কথা আরও কম।
নীরবতার ভেতরেও যেন কিছু জমে আছে।
নীরা হঠাৎ থেমে বলে,
— “আপনি কি কখনো মনে করেন,
আমরা কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছি?”
প্রশ্নটা সরাসরি।
কিন্তু কণ্ঠে অভিযোগ নেই।
আরিয়ান অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর বলে,
— “হ্যাঁ।
কিন্তু কখনো কখনো এড়িয়ে যাওয়া মানেই ছেড়ে দেওয়া নয়।”
নীরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
তারপর হালকা স্বরে বলে,
— “আমি ভয় পাই…
এই অপেক্ষাটা যদি একদিন ফুরিয়ে যায়?”
আরিয়ান উত্তর দেয় না সঙ্গে সঙ্গে।
শুধু ধীরে বলে,
— “আমি ভয় পাই—
যদি তাড়াহুড়ো করে সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়।”
এই প্রথম তারা দু’জনেই স্বীকার করে নেয়—
এই সম্পর্কটা বাস্তব।
অদৃশ্য হলেও।
বিদায় নেওয়ার সময় নীরা বলে না—আবার কবে দেখা হবে।
আরিয়ানও জিজ্ঞেস করে না।
তবু দু’জনেই জানে—
এই অপেক্ষার একটা ঠিকানা আছে।
রাতে নীরা ডায়েরি খুলে লেখে—
“কিছু মানুষ অপেক্ষা করতে শেখায়।
আবার কিছু মানুষ—
অপেক্ষাকে ভালোবাসা বানিয়ে দেয়।”
আরিয়ান জানালার পাশে বসে থাকে।
আজ শহরটা অদ্ভুতভাবে শান্ত।
তার মনে হয়—
ভালোবাসা সবসময় হাতে হাত রেখে হাঁটা নয়।
কখনো কখনো ভালোবাসা মানে
দূরে দাঁড়িয়ে থেকেও
একই দিকে তাকিয়ে থাকা।
আর সেই দিকটার নাম—
অপেক্ষা।
📖 অধ্যায় ৭
বুঝেও না বোঝার অভিনয়
মানুষ সব বুঝেও অনেক সময় কিছু বোঝে না—
এমন অভিনয় করে।
কারণ বোঝা মানেই দায়িত্ব,
আর দায়িত্ব মানেই বদলে যাওয়া।
আরিয়ান আর নীরা এখন ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
তারা দু’জনেই জানে—এই সম্পর্কটা আর কেবল কাকতাল বা অভ্যাস নয়।
তবু কেউই সেটা মুখে আনে না।
যেন শব্দে আনলেই সবকিছু ভেঙে পড়বে।
এক বিকেলে তারা পাশাপাশি বসেছিল পার্কের বেঞ্চে।
চারপাশে মানুষ।
হাসি, গল্প, বাচ্চাদের দৌড়ঝাঁপ।
নীরা সামনে তাকিয়ে ছিল।
আরিয়ান পাশ থেকে তাকিয়ে ছিল—নীরার কপালের চিন্তার ভাঁজের দিকে।
— “আপনি কি কখনো এমন কাউকে দেখেছেন,”
নীরা হঠাৎ বলল,
“যে খুব কাছে থেকেও দূরে থাকে?”
আরিয়ান বুঝে গেল—এই প্রশ্ন তার জন্যই।
তবু সে সরাসরি তাকাল না।
— “দেখেছি,” সে বলল,
“অনেক সময় মানুষ নিজেকেই দূরে রাখে।”
নীরা হালকা হাসে।
এই হাসির ভেতরে আনন্দ নেই।
আছে একধরনের স্বীকারোক্তি।
কিছুক্ষণ পর সে বলে,
— “আমার মাঝে মাঝে মনে হয়…
আমরা দু’জনেই খুব সাবধানে হাঁটছি।”
আরিয়ান এবার তাকায়।
চোখে চোখ পড়ে।
— “সাবধান না হলে পড়ে যেতে পারি,”
সে বলে।
নীরা কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
তারপর ধীরে বলে,
— “কিন্তু পড়ে গেলে কেউ ধরবে—
এই ভরসাটা থাকলে কি সাবধানতা দরকার হয়?”
এই প্রশ্নটার উত্তর আরিয়ান জানে।
কিন্তু দিতে চায় না।
সে জানে—
এই ভরসা দিলে, নিজেকেও বদলাতে হবে।
নিজের নির্ভরশীলতাকেও মেনে নিতে হবে।
সে শুধু বলে,
— “সব ভরসাই একরকম না।”
এই কথায় নীরা আর কিছু বলে না।
কিন্তু তার চোখে একধরনের আড়াল নেমে আসে।
সেদিন তারা আগেভাগেই আলাদা হয়ে যায়।
নীরা বাসে বসে ভাবে—
সে কি খুব বেশি আশা করছে?
না কি খুব কম সাহস দেখাচ্ছে?
আরিয়ান হাঁটতে হাঁটতে ভাবে—
সে কি নীরাকে কষ্ট দিচ্ছে?
না কি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে?
দু’জনেই জানে—
এই সম্পর্কটা আর অজানা নেই।
তবু তারা দু’জনেই
বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে যায়।
কারণ কিছু অনুভূতি স্বীকার করলে
শুধু ভালোবাসা আসে না—
আসে ভয়, দায়, আর হারানোর সম্ভাবনাও।
আর সেই সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো
তারা দু’জনেই এখনো পুরো প্রস্তুত নয়।
শহর রাতের দিকে ঢলে পড়ে।
আলো জ্বলে।
মানুষ বাড়ি ফেরে।
দূরে, আলাদা দু’টি ঘরে
আরিয়ান আর নীরা
একই প্রশ্ন নিয়ে বসে থাকে—
“আর কতদিন এভাবে চলবে?”
কিন্তু প্রশ্নের উত্তর কেউই এখনো চায় না।
📖 অধ্যায় ৮
দূরত্বের ভিতরে জন্ম নেওয়া টান
দূরত্ব সবসময় আলাদা করে না।
কখনো কখনো দূরত্বই
সবচেয়ে স্পষ্ট করে দেয়—
কে কতটা প্রয়োজন।
আরিয়ান আর নীরার মাঝখানে
এবার ঠিক তেমনই এক নীরব দূরত্ব এসে দাঁড়াল।
কয়েকদিন ধরে তাদের দেখা হয়নি।
কথাও হয়নি।
ইচ্ছে করেও কেউ যোগাযোগ করেনি।
নীরা নিজের কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে।
অফিস, ফাইল, সময়—সব ঠিকঠাক।
তবু দুপুরের বিরতিতে হঠাৎ মনে পড়ে—
আরিয়ান এখন কী করছে?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
তবু প্রশ্নটা ফিরে ফিরে আসে।
আরিয়ানও নিজের ভেতরে একটা অস্বস্তি টের পায়।
তার নীরবতা এখন আর আগের মতো স্বস্তির নয়।
বরং মনে হয়—
কাউকে না জানিয়ে সে খুব কাছের কিছু হারিয়ে ফেলছে।
এক সন্ধ্যায় সে হঠাৎ বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে।
কোনো কারণ ছাড়াই।
চায়ের দোকান।
চেনা জায়গা।
নীরা নেই।
আরিয়ান চা নেয় না।
শুধু দাঁড়িয়ে থাকে।
এই প্রথম সে বোঝে—
অভ্যাস ভেঙে গেলে কতটা ফাঁকা লাগে।
নীরা সেই সন্ধ্যায় বাসে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল।
অজান্তেই চোখ ভিজে আসে।
সে নিজেকেই বলে,
“এটা দুর্বলতা নয়।
এটা শুধু অভ্যাস।”
কিন্তু সে জানে—
এই অভ্যাসটা আর সাধারণ নয়।
কয়েকদিন পর হঠাৎ দেখা।
রাস্তার মোড়ে।
দু’জনেই থেমে যায়।
এইবার নীরবতাটা অস্বস্তিকর।
কিন্তু কারও মুখে অভিযোগ নেই।
নীরা প্রথম বলে,
— “ভালো আছেন?”
আরিয়ান মাথা নেড়ে বলে,
— “আপনিও?”
এই দুইটা সাধারণ প্রশ্নের ভেতরে
অনেক না বলা কথা আটকে থাকে।
কিছুক্ষণ পর আরিয়ান ধীরে বলে,
— “আমি ভেবেছিলাম…
হয়তো আপনি আর আসবেন না।”
নীরা তাকিয়ে থাকে।
তার চোখে কষ্ট নেই,
আছে স্বচ্ছ সত্য।
— “আমিও ভেবেছিলাম,
আপনি চাইলে একবার ডাকতেন।”
এই কথার পর দু’জনেই চুপ করে যায়।
এই প্রথম তারা বোঝে—
দূরত্বটা ইচ্ছাকৃত ছিল না।
ছিল ভয় থেকে জন্ম নেওয়া।
আরিয়ান নিচু স্বরে বলে,
— “আমি আপনাকে হারাতে ভয় পাই।”
এই বাক্যটা কোনো প্রস্তাব নয়।
কোনো দাবি নয়।
তবু নীরার বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে কিছু।
সে ধীরে বলে,
— “আমিও।”
এই দুইটি শব্দে
সব দূরত্ব হালকা হয়ে আসে।
তারা পাশাপাশি হাঁটে।
আগের মতো।
কিন্তু আজ নীরবতার ভেতরে আর শূন্যতা নেই।
আছে টান।
একটা টান,
যেটা দূরত্বের ভেতরেই জন্ম নিয়েছে।
আর সেই টানটাই
এখন তাদের সবচেয়ে বড় সত্য।
📖 অধ্যায় ৯
একদিন হঠাৎ নীরব ভাঙে
শহরের বিকেল ধীরে ঘন হয়ে আসছিল।
মানুষের ভিড় কমছে।
আকাশে ধোঁয়া মাখা আলো, যেন শহরকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলছে।
আরিয়ান অফিস থেকে বের হয়ে হঠাৎ পার্কের দিকে চলে আসে।
নীরার মতো কিছুতেই তার চোখ খুঁজছিল—
কিন্তু ঠিক কবে দেখেছে, সে জানত না।
শুধু অভ্যাস হয়ে গেছে—কেউ আছে কি না, তা খুঁজে বের করার।
নীরা সেখানে ছিল।
একটি বেনচে বসে।
হাতের মধ্যে ছোট একটি নোটবুক।
লিখছিল না, শুধু তাকিয়ে ছিল।
আরিয়ান কাছে আসে।
এইবার সে থামল না।
কিছুক্ষণ দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
নীরা হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।
চোখে একধরনের অস্থিরতা।
ধীরে ধীরে বলল—
— “আমি আর পারছি না… আর নিঃশব্দ থাকতে।”
আরিয়ান একটু হকচকিয়ে তাকায়।
এই প্রথম সে শুনল—নীরার ভেতরের টান, ধীর নীরবতার আড়ালে চাপা থাকা সব অনুভূতি,
এখন শব্দে আসছে।
— “আমি ভাবছি, আমরা কি সত্যিই একে অপরকে চাই না?”
নীরা বলল, চোখে জল জমে আসে।
— “কিন্তু আমি চাই… অনেক চুপচাপ চেয়েছি।
আপনিও কি চেয়েছেন?”
আরিয়ান কিছু বলে না।
শুধু ধীরে হাত বাড়িয়ে ধরে নীরার হাত।
এই স্পর্শে সব কথা বলা হয়ে যায়।
— “আমি চাইছি,” সে অবশেষে বলে।
কণ্ঠে কোনো নাটকীয়তা নেই।
শুধু সত্য।
নীরা হেসে ফেলে,
কিন্তু সে হাসিটা খুশির নয়।
এটা একধরনের মুক্তি—
অপেক্ষার শেষে, দীর্ঘ সময়ের চাপা অনুভূতি এবার মুক্ত।
তারা দুইজন বসে যায়।
পাশে বসা মানুষ নেই।
শুধু তারা দু’জন।
শহরের শব্দ তাদেরকে স্পর্শ করে না।
— “ধীরে ধীরে হলেও বলা ভালো, না কি?”
নীরা বলল।
— “হ্যাঁ… ধীরে ধীরে,”
আরিয়ান বলে।
— “কারণ ধীরে ধীরে বোঝা সব থেকে সঠিক হয়।”
সেদিন থেকে তাদের নীরবতা আর ভাঙেনি।
বরং তা কথার সঙ্গে মিশে গেছে।
কিছু না বলেও তারা বুঝে গেছে—
একটি সম্পর্কের সত্যিকারের অর্থ।
শহর ঘুমোতে শুরু করে।
আকাশে তারকার আলো ম্লান।
তাদের ভালোবাসা—ধীরে হলেও
গভীর হয়ে উঠছে।
📖 অধ্যায় ১০
যে বিচ্ছেদ কেউ চায়নি
কিছু সময়, সম্পর্ক যতই দৃঢ় হোক—
জীবনের অজানা বাঁকগুলো সবকিছু বদলে দিতে পারে।
আরিয়ান আর নীরার জন্যও সেই বাঁক এসে হাজির হলো হঠাৎ।
নীরার অফিসে হঠাৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
কাজের চাপ বাড়ছে।
প্রতিদিনের নিয়মিত দেখা আর কথোপকথন এখন একেবারে অসম্ভব হয়ে যায়।
আরিয়ানও নিজের কাজের মধ্যে ব্যস্ত।
কিন্তু তার ভেতর একটা অশান্তি জন্ম নেয়—
নীরা আজ কেন নেই, না বলছে, না ফোন করছে।
এক সন্ধ্যায় তারা দেখা করার চেষ্টা করে।
নীরা হঠাৎ ফোনে বলে—
— “আমি আসব না আজ। খুব ব্যস্ত।”
আরিয়ান বুঝতে পারে—এই “খুব ব্যস্ত” শব্দের ভেতর দিয়ে দূরত্ব ঢুকে পড়ছে।
কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না।
কারণ বোঝায় কীভাবে যে, সে খারাপ লাগছে?
পরের কয়েকদিনে দেখা হয় না।
কথাও হয় না।
দু’জনের মনেই একটা অদৃশ্য দেয়াল উঠতে শুরু করে।
নীরা নিজের ঘরে বসে ভাবছে—
“আমি কি খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছি?
না কি শুধু নিজের জায়গা চাইছিলাম?”
আরিয়ান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছে—
“আমি কি খুব চাপ সৃষ্টি করেছি?
না কি শুধু এই দূরত্বটাই আমাদের ভালোবাসাকে পরীক্ষা করছে?”
দু’জনই জানে—কেউ চাইছে না বিচ্ছেদ।
কিন্তু শব্দ ছাড়া, সময়ের চাপে, দূরত্বের কারণে
বিচ্ছেদ নিজেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে।
একদিন হঠাৎ আরিয়ান ফোনে কণ্ঠ শুনতে পায়।
নীরার কণ্ঠ—হালকা কাঁপছে।
— “আমরা কি… খুব বেশি দূরে চলে যাচ্ছি?”
আরিয়ান থেমে যায়।
শুধু একটি শব্দে বোঝে—এটা কোনো অভিযোগ নয়।
এটা কেবল আত্মসমালোচনা, এবং ভীতি।
— “না… আমরা ফিরে আসতে পারব,”
সে বলে।
— “শুধু আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”
নীরা চুপ করে যায়।
কিন্তু তার চোখের ভেতর অদ্ভুতভাবে শান্তি আসে।
যেন কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করছে—
কথা নয়, শুধু মন দিয়ে।
শহর ঘুমোতে শুরু করে।
দু’জনের মাঝের দূরত্ব আছে।
কিন্তু সেই দূরত্বে টানটা শক্তিশালী হচ্ছে—
যার নাম ভালোবাসা।
📖 অধ্যায় ১১
স্মৃতির সাথে একা বসবাস
বিচ্ছেদ সবসময় শব্দে আসে না।
কখনো সেটা আসে নিঃশব্দ ক্ষত, স্মৃতির ভেতর ধোঁয়া হয়ে।
নীরা এখন তার ফ্ল্যাটে একা।
চায়ের কাপ হাতে নিয়েই জানালার পাশে বসে থাকে।
শহরের শব্দ দূরে ঠেকছে।
তবে সে শোনে—মাঝে মাঝে নিজের ভেতরের নীরবতা।
বসন্তের হালকা বাতাস জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে।
নীরা নিজের চোখে চোখ রাখে—ডায়েরির পাতায় লেখা কিছু লাইন পড়ে।
“আমরা ভালোবাসি।
কিন্তু সব সময় কাছাকাছি থাকতে পারি না।
দূরত্বে থেকেও আমরা একসাথে।”
এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে তার বুক ভারী হয়ে আসে।
মাথায় বারবার খেলা করে—আরিয়ান, হেসে থাকা মুখ, চোখের ভেতরের অদৃশ্য বার্তা।
আরিয়ানও তার নিজস্ব একাকীত্বে ডুবে থাকে।
অফিসের জানালার পাশে বসে হঠাৎ মনে পড়ে—নীরার হাতের মৃদু স্পর্শ, ধীরে বলার কণ্ঠ।
কাজে মন যায় না।
শুধু স্মৃতি ঘোরে, ভেতরের নীরবতা আরও গভীর হয়ে ওঠে।
দু’জনই জানে—এটাই প্রকৃত বাস্তবতা।
ভালোবাসা মানেই সবসময় কাছে থাকা নয়।
কখনো কখনো মানে স্মৃতির সঙ্গে একা বসবাস করা।
সন্ধ্যার আলো নিভে আসে।
নীরা ডায়েরি বন্ধ করে রাখে।
আরিয়ান জানালার পাশে হাত রাখে।
দু’জনেরই মনে হয়—কিছু সময় লাগে,
কিন্তু ভালোবাসা ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসে।
একটি সত্য তারা ভেতর থেকে বোঝে—
যারা সত্যিকারের ভালোবাসে, তারা দূরে থেকেও একে অপরের কাছাকাছি থাকে।
শুধু ধৈর্য দরকার।
আর কিছুটা আশা।
📖 অধ্যায় ১২
সময় কি সব বদলায়?
সময়কে মানুষ দোষ দেয়।
আবার সময়ের কাছেই মানুষ সবচেয়ে বেশি আশাও রাখে।
নীরা এখন আগের চেয়ে অনেক শান্ত।
কাজের চাপ আগের মতোই আছে,
কিন্তু মনটা আর আগের মতো ছটফট করে না।
সে শিখে গেছে—সব অনুভূতির তাৎক্ষণিক সমাধান হয় না।
সকালের আলোয় সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুছায়।
হঠাৎ নিজের চোখে একধরনের স্থিরতা খুঁজে পায়।
এই স্থিরতা আগে ছিল না।
“সময় হয়তো সব মুছে দেয় না,”
সে ভাবে,
“কিন্তু কিছু জিনিসকে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেয়।”
আরিয়ানও বদলাচ্ছে।
সে এখন আগের মতো নীরবতায় পালিয়ে থাকে না।
নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলোকে আর এড়িয়ে যায় না।
এক বিকেলে সে পুরোনো রাস্তায় হাঁটছিল।
যে রাস্তায় নীরার সঙ্গে একাধিকবার হেঁটেছে।
সবকিছু একই আছে—
দোকান, আলো, মানুষের হাঁটা।
শুধু সে নিজে একটু বদলে গেছে।
তার মনে পড়ে—
নীরার বলা একটা কথা,
“সব ভরসাই একরকম না।”
এখন সে বুঝতে পারছে—
ভরসা মানে শুধু ধরে রাখা নয়,
ভরসা মানে জায়গা দেওয়া।
কয়েক সপ্তাহ পর হঠাৎ একটি বার্তা আসে।
নীরার ফোনে।
“আজ বিকেলে যদি সময় হয়,
চেনা চায়ের দোকানটায় বসতে পারি।”
বার্তাটা ছোট।
কিন্তু তার ভেতরে কোনো দ্বিধা নেই।
নীরা অনেকক্ষণ ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর ধীরে উত্তর লেখে—
“হ্যাঁ। সময় আছে।”
বিকেলটা খুব সাধারণ।
আকাশ পরিষ্কার।
হালকা বাতাস।
তারা মুখোমুখি বসে।
এইবার নীরবতাটা অস্বস্তিকর নয়।
বরং পরিচিত।
আরিয়ান বলে,
— “আমি বুঝেছি…
সবসময় চুপ থাকা মানেই নিরাপদ থাকা না।”
নীরা মাথা নেড়ে বলে,
— “আমিও বুঝেছি…
সব প্রশ্নের উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দরকার হয় না।”
কথাগুলো খুব বড় কিছু নয়।
কিন্তু এই কথাগুলোর ভেতর দিয়ে
একটা নতুন শুরু আস্তে আস্তে তৈরি হয়।
তারা কেউ প্রতিশ্রুতি দেয় না।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও করে না।
শুধু এই মুহূর্তটাকে সত্যি করে নেয়।
চায়ের কাপের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে
নীরা ভাবে—
সময় হয়তো সব বদলায় না।
কিন্তু সময় সুযোগ দেয়—
মানুষকে একটু পরিণত হওয়ার,
আর ভালোবাসাকে
আরও সত্যিকারের করে তোলার।
আরিয়ান জানে—
এই সুযোগটা সে হারাতে চায় না।
ধীরে ধীরে,
খুব ধীরে—
আবার।
📖 অধ্যায় ১৩
আবার দেখা, কিন্তু অন্য রকম
কিছু মানুষ ফিরে আসে—
একই জায়গায়,
কিন্তু আর একই মানুষ হয়ে নয়।
নীরা লক্ষ্য করছিল,
আরিয়ান এখন আগের মতো চোখ নামিয়ে কথা বলে না।
তার কথার মাঝে থামা আছে,
কিন্তু দ্বিধা নেই।
আরিয়ানও খেয়াল করছিল—
নীরা আর তাড়াহুড়ো করে কিছু বোঝাতে চায় না।
তার নীরবতা এখন আর অপেক্ষার নয়,
বরং বোঝাপড়ার।
তারা আবার নিয়মিত দেখা করতে শুরু করে।
কিন্তু আগের মতো প্রতিদিন নয়।
সময় পেলেই—মন চাইলে।
এই স্বাধীনতাটা দু’জনের কাছেই নতুন।
আরামদায়ক।
একদিন তারা হাঁটছিল নদীর ধারে।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে।
আকাশে রঙের স্তর।
নীরা থেমে দাঁড়িয়ে বলল,
— “আমরা কি বদলে গেছি?”
প্রশ্নটা অভিযোগ নয়।
কৌতূহল।
আরিয়ান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
— “হয়তো বদলেছি।
কিন্তু আগের চেয়ে সৎ হয়েছি।”
নীরা হালকা হাসে।
— “আমি আগের চেয়ে কম ভয় পাই।”
এই কথাটা আরিয়ানকে স্পর্শ করে।
সে জানে—এই ভয়টাই একসময় দু’জনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।
তারা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
কেউ কারও হাত ধরে না।
তবু কাছাকাছি।
আরিয়ান ধীরে বলে,
— “আমি চাই না আমরা আবার হারিয়ে যাই।”
নীরা তাকায় তার দিকে।
চোখে কোনো অস্থিরতা নেই।
— “আমিও না,”
সে বলে।
— “কিন্তু এইবার… ধীরে।”
এই “ধীরে” শব্দটা দু’জনের কাছেই পরিচিত।
এই শব্দেই একসময় শুরু হয়েছিল সব।
তারা বুঝতে পারে—
ভালোবাসা আবার ফিরে এসেছে।
কিন্তু এইবার সেটা দাবি নিয়ে নয়,
বরং দায়িত্ব নিয়ে।
ফেরার পথে নীরা মনে মনে ভাবে—
সব পুনর্মিলন একরকম হয় না।
কিছু পুনর্মিলন মানুষকে বড় করে তোলে।
আরিয়ান জানে—
এই সম্পর্ক এখন আর শুধু অনুভূতির নয়,
এটা সচেতনতারও।
শহরের আলো জ্বলে ওঠে।
নদীর পানি অন্ধকারে মিশে যায়।
আর সেই অন্ধকারের ভেতরেও
দু’জন মানুষ
পরিষ্কার দেখতে পায়—
একটা ভবিষ্যৎ,
যা হয়তো নিশ্চিত নয়,
কিন্তু সত্য।📖 অধ্যায় ১৪
ভালোবাসা কি ফিরে আসে?
ভালোবাসা কি সত্যিই ফিরে আসে?
নাকি সে কখনো যায়ই না—
শুধু মানুষ বদলে গেলে
তার রূপ বদলায়?
নীরা এই প্রশ্নটা অনেকদিন ধরেই নিজের ভেতরে বয়ে বেড়াচ্ছিল।
আজ হঠাৎ মনে হলো—
প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার তাড়া আর নেই।
সে আরিয়ানকে দেখছিল।
চেনা মুখ,
তবু আগের চেয়ে আলাদা।
এই মানুষটা এখন আর নীরবতায় লুকায় না।
আর সে নিজেও আর অনুভূতিকে ভয় পায় না।
তারা একসাথে বসে ছিল সেই চায়ের দোকানে—
যেখান থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল।
কাপের ধোঁয়া উঠছে।
বিকেলের আলো ধীরে ফিকে হচ্ছে।
আরিয়ান হঠাৎ বলল,
— “আমরা অনেক কিছু পার হইনি?”
নীরা তাকিয়ে হাসল।
— “হয়তো পার হয়েছি।
হয়তো শিখেছি।”
আরিয়ান মাথা নেড়ে বলল,
— “আমি বুঝেছি…
ভালোবাসা মানে শুধু ধরে রাখা না।
ভালোবাসা মানে জায়গা দেওয়া।”
নীরা ধীরে বলে,
— “আর ফিরে আসা মানে আগের জায়গায় ফেরা না।
ফিরে আসা মানে নতুন করে বেছে নেওয়া।”
এই কথাগুলোর পর আর কিছু বলার দরকার পড়ে না।
তারা কেউ ভবিষ্যতের ছবি আঁকে না।
বিয়ে, প্রতিশ্রুতি, চিরকাল—এই শব্দগুলো আসে না।
কিন্তু দু’জনেই জানে—
তারা এখন আর একে অপরের জীবনে কাকতাল নয়।
সন্ধ্যার আলো নিভে আসে।
চায়ের দোকান বন্ধের প্রস্তুতি নেয়।
বেরোনোর সময় আরিয়ান বলে,
— “কাল দেখা হবে?”
নীরা কোনো নাটক ছাড়াই উত্তর দেয়,
— “হ্যাঁ।
যদি না-ও হয়… তবু ঠিক আছে।”
এই ‘ঠিক আছে’-র ভেতরেই
সবচেয়ে বড় ভরসা লুকিয়ে থাকে।
তারা পাশাপাশি হাঁটে।
হাত ধরে না।
কিন্তু দূরত্ব নেই।
শহর তাদের গ্রহণ করে নেয়—
দু’জন মানুষ হিসেবে,
যারা ভালোবাসাকে আর স্বপ্ন নয়,
বাস্তব হিসেবে বেছে নিয়েছে।
ভালোবাসা কি ফিরে আসে?
হয়তো আসে না।
হয়তো যায়ও না।
হয়তো ভালোবাসা
শুধু অপেক্ষা করে—
মানুষ কখন পরিণত হয়ে
তাকে ঠিকভাবে ধারণ করতে শেখে।
✦ সমাপ্ত ✦