ঝরাপাতা
পর্ব - ৩৭
❤💜❤💜❤💜❤
রনির ধিক্কারে এতক্ষণ জমে থাকা সব রাগ, অপমান জল হয়ে চোখ থেকে গড়াতে থাকে মিলির। রনি কথাটা বলতে বলতে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, এই নিঃশব্দ কান্না দেখতে পায় না। সমর আর গোপা বিশ্বাস না করলেও এখন কি বলবে ভেবে পায় না।
যেহেতু চন্দন সাহার পরিচয় মিলিই নিজের মুখে বলেছে, এখন রনির কথায় ওর চোখে জল দেখে বনি আর পিউ বোঝে, মিলির দোষ নেই। পিউ মিলিকে জড়িয়ে ধরে বলে, "কি হয়েছে আমাকে বলতো। সবটা খুলে বল।"
- "ও কি বলবে? মুখ আছে ওর বলার?" রনির গলায় এবার শান্ত ব্যঙ্গ।
- "দাঁড়াও ভাই, কিছু একটা গোলমাল আছে। ওকে বলতে দাও। কান্না বন্ধ কর তো মিলি, কি হয়েছে, কি বলেছিস তুই, বল আমাকে।" পিউ মিলির চোখ মুছে দেয়। রনি ছিঃ ছিঃ বলতে বলতে এতক্ষণে সোফায় বসে পড়ে। দুহাত জড়ো করে সামনে ঝুঁকে বসে আপশোষে মাথা নাড়ছে। মিলির মুখের দিকে আর ফিরে তাকায়নি।
গোপা এগিয়ে এসে মেয়ের কাঁধে হাত রাখে, "যা জানিস বলতো মা। ভয় পাস না। আমি আর তোর বাবা এবার তোর পাশে আছি।"
মায়ের আদরে মিলির কান্নার বেগ বেড়ে যায়, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, "আমি কিচ্ছু জানি না। কখনো পলাশের বাবাকে দেখিওনি। ওদের অনেক বড় ব্যবসা আছে। ওর স্কুলের বন্ধুরা সেসব গল্প করে, শুনেছি। তাকে আমার পরীক্ষার কথা কি করে বলব? আর বললেই কাজ হবে নাকি? এভাবে পরীক্ষা দিয়ে কি লাভ? ম্যাডাম তো বলেছেন, তাহলে রেজাল্ট ভালো হবে না।"
রনি লাফিয়ে উঠে বলে, "রেজাল্ট কেন ভালো হবে না? রেজাল্টটাও তুমি এভাবে কিনতে।"
- "রনি আর একটা বাজে কথা বললে আমি তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে বাধ্য হব। তোমার একটা অন্যায় মাপ করেছি। ভেবেছিলাম, ছেলেমানুষ, আমার ছেলের মতো তুমি, একটা অন্যায় করে কষ্ট পাচ্ছ। আজ বুঝেছি, অত্যন্ত অভদ্র ছেলে তুমি। নিজের হাতে নিজের মেয়ের সর্বনাশ করেছি আমরা।" সমর গর্জন করে ওঠে।
সমরের উঁচু গলা নয়, কথাগুলো রনিকে আঘাত করে। নিজের অন্যায়ের বোধ ওর আছে। এই ঘটনা শোনার আগে পর্যন্ত নিজের অপরাধের কথাই ওর মাথায় ছিল। তাই সমরের কথায় আবার মাথা নিচু করে ফেলে।
বনি ভাইয়ের সামনে এসে বলে, "তোকে খুবই অপমান সহ্য করতে হয়েছে, আমি বুঝেছি। কিন্তু পুরো ঘটনাটা কি সেটা একটু জানতে দে। আর নাহয় এক কাজ কর, তুই বাড়ি যা। আমি মিলির সঙ্গে কথা বলে আসছি।"
দাদার দিকে মুখ তুলে তাকায় রনি, "সবাই আমাকে থামিয়ে দিচ্ছিস ! মিলির অন্যায়টা কেউ দেখছিস না ! ও কাকে সিলেক্ট করেছে বুঝেছিস? সাহা বুক হাউজের মালিক ! কোটি কোটি টাকা ওদের। তিন পুরুষের ব্যবসা। দেখে আয়, ওর সঙ্গে পড়ে যে ছেলে, তারই নামে জন্মে থেকে ব্যাঙ্কে কোটি টাকা পচছে। ওরা টাকা দিয়ে সব কিনে নেয়। আমি ডঃ চক্রবর্তীকে চিনি, আদ্যন্ত সৎ মানুষ। অন্য কেউ হলে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যেত।" গলা নামিয়েই বলে রনি, তবে মিলির প্রতি বিদ্বেষ স্পষ্ট।
- "দেখ ভাই, তোর এই কথাগুলো ঠিক। কারণ এগুলো ডঃ চক্রবর্তী বলছেন, চৈতালী ম্যাডাম বলছেন। টাকা ওরা অফার করেছে। কিন্তু ওরাও না ব্যবসায়ী। ফালতু টাকা ঢালে না। এতগুলো টাকা ওরা মিলির জন্য খরচ করবে কেন?"
- "ওর বেস্ট ফ্রেন্ড বললাম না ! তাই...."
- "না রে, মানতে পারলাম না। ছেলেটি নিজের টাকা দিয়ে ওকে হেল্প করলে বুঝতাম। ওর বাবা, একজন পোড়খাওয়া ব্যবসায়ী এসবের মধ্যে নিজেকে জড়িয়েছেন, খুব সহজ গল্প নয়। তুই শান্ত হয়ে বোস তো। সবটা বুঝতে দে। মিলি, বল তো বোন, পলাশ ছেলেটা কেমন? মানে পড়াশোনায় খুব ভালো?"
- "মিলি যা জানিস, ওদের না হোক, আমাদের বল। তোর বাবাকে তো কলেজে গিয়ে কথা বলতে হবে। সব জানতে হবে আমাদের।" গোপা আবার বলে।
মিলি চোখ মুছে বলে, "পলাশ খুব ভালো কিছু না পড়াশোনায়। এমনিতে ভালোই, বুদ্ধিমান। তবে ওর মা নেই, সৎমা। তাই ও যা চায় ওর বাবা দেন। না দিলেই মুড অফ করে থাকে। তাতেও বোধহয় পড়াশোনার ক্ষতি হয় কিছুটা।"
- "আ চ ছা ! একটু একটু বুঝতে পারছি ! হ্যাঁ রে মিলি, তুই কি ওকে বলেছিস, দুটো পরীক্ষা দিতে চাস? ভয় পাস না, আমরা সবাই আছি, রনি তোকে কিচ্ছু করতে পারবে না, তুই বল।" বনি আশ্বাস দেয়।
পিউ মিলিকে রনির পাশেই সোফায় বসাতে যাচ্ছিল, মিলি অন্য সোফাটায় বসে। মুখটুখ মুছে বলে, "হ্যাঁ বলেছি। সে তো সবাইকে বলেছি। কথাটা উঠেছিল। রনিদা এখন এতকিছু বলল আমাকে, রনিদাকেও তো বলেছি। তখন রনিদা চৈতালী ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। আমি ম্যাডামের সব কথা শুনি, রনিদার সব কথা শুনি। কলেজ আর পড়তে যাওয়া ছাড়া কোথাও যাই কিনা রনিদা বলুক। তাও সেদিন বন্ধুরা সিনেমায় যাবে বলেছিল বলে কত বকল। আজকেও এসে..."
বনি বোঝে, মিলির কথা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে, চটপট থামায়, "তোর রনিদাকে পরে পালিশ করব। তুই এখন বল, পলাশকে কি কি বলেছিস?"
- "কি আবার বলব? ম্যাডাম বলেছেন দুটো পরীক্ষা দেওয়ার মতো পড়াশোনা হয়নি, এটা বলেছি। তাই মন দিয়ে পড়তে হবে, মা এখন বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমায় যেতে দেবে না বলেছি। কাল সন্ধ্যায় ও ফোন করে বলল, আজ একটা সারপ্রাইজ দেবে। আজ বলল রেডি হয়নি। এইসব গল্প।"
প্রত্যেকেই, এমনকি রনিও বুঝতে পারে, মিলি সত্যি কথা বলছে। এখন তাহলে কি করা যায়? কাল তো প্রিন্সিপাল স্যারের সামনে মিলিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে !
রনি বলে, "পলাশকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো তো ও ওর বাবার সঙ্গে এই নিয়ে কোনো কথা বলেছে কিনা।"
বনি যতক্ষণ কথা বলছিল, সমর চুপ করে ছিল, এখন বলে, "কাউকে ফোন করবি না মিলি। ওর কথায় চলবি নাকি তুই? কাল আমি তোকে নিয়ে কলেজে যাব। প্রিন্সিপাল স্যার পারলে পলাশের বাবাকে আমাদের সামনে ডেকে প্রমাণ দেবেন, এসব আমরা করেছি, নাহলে দুটো পরীক্ষা দিতে এ্যালাও না করতে পারেন, এবারের পরীক্ষা কি করে আটকান দেখছি। দরকারে আমি সমস্ত ঘটনা জানিয়ে শিক্ষা দফতরে চিঠি দেব। সেই চিঠির কথা প্রেসকে জানাবো।"
রনি বুঝতে পারে, ওর হাত থেকে সব বেরিয়ে গেছে। তবুও বলে, "এগুলো আমাকে বললেন তো? ঠিক আছে, ও একবার পলাশকে জিজ্ঞেস করুক না, পলাশ যদি বলে, মিলি এসব করতে বলেনি, বা ওর বাবা আদৌ স্যারের সঙ্গে দেখা করেননি, তাহলে তো আমারই দোষ প্রমাণ হবে। একেবারেই আমার নামে কমপ্লেন করবেন ইউনিভার্সিটি কাউন্সিলে। যা শাস্তি হয় হবে আমার।"
- "কাকু, আপনি রাগ করছেন, এটা ঠিক। কিন্তু পলাশকে একবার ফোন করা হোক না। ও যদি স্বীকার করে, আমরা এখনই নিশ্চিন্ত হতে পারব।" বনিও ভাইয়ের দিকেই।
গোপাও বলে, "ওকে একবার ফোন করতে দাও। সারারাত এই টেনশন নিয়ে থাকবে নাকি মিলি?"
মিলির শরীরের কথা ভেবেই সমর বলে, "ঠিক আছে। যা মামনি তোর ফোন থেকে তোর ঐ বন্ধুকে ফোন কর। শুধু জিজ্ঞেস করবি, ও ওর বাবাকে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে পাঠিয়েছে কিনা।"
মিলি উঠতেই রনি বলে, "শোনো, ফোনকলটা পারলে রেকর্ড কোরো। ছেলেটি কাল অস্বীকার করতে পারে।"
মিলির চোখে আর জল নেই, বরং আগুন চোখে তাকায়, "কাল কেন, আজকেও অস্বীকার করবে। তুমি তো বললেই, সব আমি করেছি, আমার বাবা মা আমাকে সাপোর্ট করেছে। সেইজন্যই তো ফোন করতে বলছ, যাতে আমি দোষী প্রমাণ হয়।"
রনির মনে হয় ওর জ্বরটা আবার ফিরে এসেছে। সমস্ত ক্ষেত্রে ও প্রথমেই একটা কিছু মনে মনে ভেবে নেয়, আর তারপর.....
মিলি ফোন এনে সবার সামনে ডায়াল করে, লাউডস্পিকারে দেয়, সবাই ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিন চারবার রিঙ হতেই পলাশ হ্যালো বলে। রেকর্ডিং বাটন অন করে মিলি বলে, "পলাশ, তোর বাবা কি আজ আমাদের কলেজে এসেছিলেন, প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে দেখা করেছেন?"
- "হ্যাঁ তো। কিন্তু তুই কি করে জানলি?"
- "তোর বাবা আমার পরীক্ষা নিয়ে স্যারকে কিছু বলেছেন? আর সেগুলো আমি তোদের স্যারকে বলতে বলেছি?"
- "কি হয়েছে রে অদ্রিজা? তোর গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন?" পলাশের মিলির জন্য চিন্তাটা সবার কানে বাজে।
- "হয়েছে অনেককিছু। সেজন্যই তোকে জিজ্ঞেস করছি। তুই আমাকে বল, আমি তোকে বলেছি এসব কথা স্যারকে বলতে?"
- "না না তুই কেন স্যারকে বলতে বলবি? আমি ভেবেছিলাম তোর ইচ্ছেটা পূরণ করব। তাই স্যারকে বলতে বলেছিলাম বাবাকে। এ্যাই শোন, তুই কি করে জানলি? স্যার বলেছেন? কখন বললেন? আমরা সবাই একসঙ্গে ফিরলাম। তখনও কিছু কথা হল না। ইস আমি ভেবেছিলাম আমি নিজে তোকে খবরটা দেব, তখন তুই বুঝবি আমার মতো বন্ধু তোর কেউ নেই। সেজন্যই সারপ্রাইজটা আমি প্ল্যান করলাম। " পলাশের গলায় আপশোষ।
- "খুব ভালো সারপ্রাইজ দিয়েছিস রে। সত্যিই তোর মতো বন্ধু কেউ হতে পারে না প্রমাণ করে দিয়েছিস। প্রিন্সিপাল স্যারকে তোর বাবা টাকা অফার করেছেন?"
- ''টাকা কি আর ওভাবে অফার করা যায়? স্যারের বইয়ের জন্য ধর লাখ পাঁচেক টাকা বেশি দেওয়া হবে। এই এবার পরীক্ষার পর বাড়ির সবাই ইতালি যাওয়ার কথা। আমি বাবাকে বলেছি, আমি যাব না। তার বদলে এটা করে দিতে হবে আমাকে। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। আরে আমার টাকা কি তোর না? এখন এই কাজটা হয়ে যাক, পরে বেড়াতে যাব।"
- "আমি কিছু ভাবতেই পারছি না রে। তুই যা করেছিস ! প্রিন্সিপাল স্যার অসম্ভব রেগে গেছেন এই ম্যানুপুলেশন দেখে। আমাকে পরীক্ষাই দিতে দেবেন না, বাবাকে দেখা করতে ডেকেছেন। তার উপর আমার বাড়ি বয়ে এসে পাড়ার লোক বলে যাচ্ছে, আমরাই এসব করিয়েছি। খুব ভালো করেছিস পলাশ, খুব ভালো।" মিলি কেঁদে ফেলে। পাড়ার লোক কথাটা শুনে রনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মিলির কান্নায় এখন বুক ফেটে যাচ্ছে ওর।
- অদ্রিজা, শোন শোন অদ্রিজা, কি বলছিস এসব? তোকে পরীক্ষা দিতে দেবেন না কেন স্যার?"
- "সবাই লোভী হয় না পলাশ। তোমার নিজের শিক্ষক সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। তাই আমার মেয়েটার এই সর্বনাশ করলে।" সমর মিলির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে।
- "কাকু, আমি বুঝতে পারিনি এরকম হবে। বাবা রাজি হচ্ছিল না। আমিই খাব না বলে বাড়িতে অশান্তি করে রাজি করিয়েছি। কাকু আপনারা ভাববেন না, আমি কাল স্যারকে সব কথা বলব। আমাকে রাস্টিকেট করলে করবেন স্যার, অদ্রিজার কোনো ক্ষতি হতে দেব না। ও ঠিক পরীক্ষা দেবে। ওকে একটু ফোনটা দেবেন?"
সমর ফোনটা এগিয়ে দেয়, মিলি নেয় না, মাথা নেড়ে কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে যায়। সমর আবার বলে, "দেখি তুমি কাল কতদূর কি কর। আর তোমার বন্ধু এখন কথা বলতে পারছে না, ও উঠে চলে গেছে। রাখছি আমি।" ফোনটা কেটে একধারে একটা চেয়ারে এসে বসে সমর।
রনি সবে কাকু বলে ডেকে কিছু বলতে যায়, সমর বলে, "ও হ্যাঁ, তোমার সঙ্গেও একটা বোঝাপড়া করতে হবে। থ্যাঙ্কিউ রনি, তোমার বুদ্ধিতে ওকে ফোন করা হল, রেকর্ড রাখা হল। ছেলেটি কাল পালটি খেলেও সম্ভবত মিলি বেঁচে যাবে। আর তোমারও যে মিলির পড়াশোনার সঙ্গে জড়িয়ে আছ বলে বদনাম হল, সেটা নিশ্চয়ই কেটে যাবে। প্রিন্সিপাল বা চৈতালী ম্যাডাম আর তোমাকে দোষ দেবেন না। এবার তোমরা এসো। যত টাকা তুমি আমাকে দিয়েছ, কাল ফিক্সডটা ভাঙিয়ে তোমাকে দিয়ে দেব। আরও উপকার করেছ, মিলিকে আনা নেওয়া করেছ, তার জন্য আমরা পুরো পরিবার আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।" একবার হাতজোড় করে সমর উঠে পড়ে।
চলবে