Divorce - 3 in Bengali Moral Stories by DR RAJESH CHOUDHURI books and stories PDF | বিবাহবিভ্রাট - 3

Featured Books
Categories
Share

বিবাহবিভ্রাট - 3

আজকে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে আমাদের প্রজনন বিজ্ঞানীরা যেমনভাবে দিনরাত গবেষণায় রত,- কিভাবে, কোন জিনের সাথে কোন জিনের ক্রশ করালে উন্নত মানের গরু, ঘোড়া, গাধা, কুকুর, ধান, গম, ফুল ইত্যাদির জন্ম দেওয়া যায়,- ঠিক তেমনি আমাদের দেশের আর্য্য ঋষিগন অতি সুপ্রাচীন কালেই তাদের গভীর সাধনালব্ধ পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের বিবাহ ব্যাপারে কতগুলি নীতি-বিধি প্রচলন করেছিলেন৷ যে নীতি-বিধি অনুযায়ী বিবাহ হলে সুসন্তানের জন্ম হয় এবং সাংসারিক স্থিরতা অনেকটাই বজায় থাকে । বিবাহের মূল উদ্দেশ্য,-" উন্নয়ন আর সুপ্রজনন" পূরন হয়।  আমাদের বেদে, পুরানে, বিভিন্ন শাস্ত্রে সেইসকল বিধিগুলির উল্লেখ রয়েছে। আমাদের দেশে সেইসময় ঘটকরা খুবই বিচক্ষন,জ্ঞানী, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন ও বিবাহনীতি সম্পর্কে খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। তারা সেইসকল নীতিবিধান অনুযায়ী, - যথাযথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজে নারী-পুরুষের বিবাহ সম্পন্ন করাতেন। তারাই ছিলেন বিবাহের আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। সুসমাজ ও উন্নত জাতি গঠনে এইসকল ঘটকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদি সমাজে ও দেশে উন্নত মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হয় তবে ঘটকগিরির কলেজ বানিয়ে সেখানে আর্য্য বিবাহনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষাদানের ব্যাবস্থা করা প্রয়োজন এবং সেইসকল ডিগ্রীধারী ঘটকদের মাধ্যমে বিবাহের প্রচলন করা উচিত। পরমপ্রেময় শ্রীশ্রীঠাকুর এমনটাই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

কালক্রমে আমরা আধুনিক হতে লাগলাম,- আমাদের তথাকথিত বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে ঋষিদের বাক্যকে বিশ্লেষণ করতে অক্ষম হওয়ায়,- আমরা ঋষিবাক্যকে অবজ্ঞাভরে ত্যাগ করতে লাগলাম। নীতিবিধিকে ভুলে নিজের প্রবৃত্তিমাফিক চলনাকেই মূখ্য করে তুললাম। যুগের পর যুগ এই অবহেলার কারনে, ঋষিবাক্যকে অবজ্ঞার কারনে একসময় আমরা ভুলেই গেলাম,- বিবাহের উদ্দেশ্য কি। আমরা ভাবতে লাগলাম,- নিজের যৌন চাহিদার পরিতৃপ্তি, চাহিদামত যৌতুক আদায়, স্ট্যাটাস বজায় রাখা এসবই বুঝি বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর,- সেদিন থেকেই বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়তে লাগল, অমানুষ জন্ম হতে লাগল, শ্রেয়ে অবজ্ঞা মাথা চাড়া দিতে লাগল। দেশের অধঃপতন সেদিন থেকেই শুরু হল। আজ আমাদের দেশে মানুষ খুবই কম,-জনসংখ্যা যদিও অনেক বেশী। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র নতুন কোন বিবাহনীতির প্রচলন করেননি। আমাদের আর্য্যঋষিদের সাধনালব্ধ যে নীতিবিধানগুলি আমরা বিস্মরন হয়েছি,- সেগুলিকেই তিনি পুনরুদ্ধার করে আরো সহজ ও বিস্তারিতভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। সেগুলিকেই তিনি অত্যন্ত গূরত্ব দিয়ে সমাজে পুনরায় প্রচলন করতে চেয়েছেন।

 আর্য্য ঋষিদের সেই বিবাহনীতি মানতে গেলেই বর্নাশ্রমকে স্বীকার করতে হয়। বর্নাশ্রম আমি মানি,- আর না'ই মানি,- প্রকৃতির মধ্যে তা রয়েছেই৷ সকল প্রজাতির মধ্যেই জেনেটিক শ্রেনীবিভাগ রয়েছে। আম যেমন ফজলী,মালদাই,হিমসাগর, দেশী ইত্যাদি নানা জেনেটিক প্রকারের হয়; কুকুর যেমন দেশী, এলশেসেসিয়ান, বুল ডগ, জার্মান শেপার্ড  ইত্যাদি নানা প্রকারের হয়,- তেমনি প্রকৃতির প্রত্যেক প্রজাতিরই জিনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আলাদা আলাদা প্রকার রয়েছে। ঠিক তেমনি, -সমাজের সঠিক পরিচালন, পরিপোষণ, শিক্ষা এবং সঠিক বিবাহের জন্য আর্য্যঋষিগন মানুষকে তাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চারভাগে বিভক্ত করেছেন,- ব্রাম্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। কোন বর্ন কোন বর্নের চেয়ে ছোট বা বড় নয়,- প্রত্যেকেই যার যার বৈশিষ্ট্যে সমাজের জন্য সমান গুরত্বপূর্ণ। কিন্তু বিবাহনীতি প্রনয়নের জন্য বর্নগুলিকে একটা ক্রম অনুযায়ী সাজানো হয়,- (১) ব্রাম্মন (২) ক্ষত্রিয় (৩) বৈশ্য এবং (৪) শূদ্র। 

যারা বর্নাশ্রমকে অস্বীকার করেন, আর্য্যঋষিদের পর্যবেক্ষন ও সিদ্ধান্তকে মানতে চান না, - তাদের অনুরোধ করব আমার এই লেখাটি পাঠ করা এখানেই বন্ধ রাখতে। কারন,-এর পরের সকল লেখা বর্নাশ্রমকে স্বীকার করেই৷ বর্নাশ্রম নিয়ে অনেক তর্ক, না মানার পক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে অনেকের কাছেই৷ তেমনি বর্নাশ্রমের পক্ষেও অনেক যুক্তি রয়েছে৷ আমি সেই যুক্তি-তর্কে যেতে চাইনা। শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা অনুযায়ী আমরা আমাদের প্রাচীন আর্য্যঋষিদের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তকে স্বীকার করি, সম্মান করি। কেউ যদি তর্ক করতে চায়,- তিনি তা করতেই পারেন। মানলে ভাল,- না মানলে যা হবার তাই হবে। 

প্রত্যেক বর্নের ভিতর আবার আলাদা আলাদা বংশ রয়েছে। আলাদা আলাদা গোত্র রয়েছে। 

প্রথমেই আর্য্য ঋষিগন যে বিবাহকে নিষিদ্ধ করলেন,- তা হল প্রতিলোম বিবাহ। যে বিবাহে স্বামীর বর্ন, বংশ স্ত্রীর বর্ন, বংশের চেয়ে কম বিবর্তিত বা কম উন্নত, - সেই বিবাহকেই তারা প্রতিলোম বিবাহ বলেছেন। প্রতিলোম বিয়েতে জিনগতভাবে সুসন্তান জন্মের সম্ভাবনা নেই বলেই ঋষিগন জানিয়েছেন। তাছাড়া সেই বিয়েতে স্বামী জিনগতভাবে স্ত্রীর চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন  হওয়ায় কখনো স্ত্রীকে যথাযথভাবে পরিপূরনে সফল হয়না। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় থাকার সম্ভাবনা কম বলে,- সংসারের স্থায়িত্ব ও শান্তির সম্ভাবনা কম। তাই সেই বিয়ে সর্বপ্রকারেই নিষিদ্ধ। শুধু বর্ন-বংশ নয়,- স্বামীর বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা স্ত্রীর চেয়ে কম হলেও তা প্রতিলোমবিবাহ বলেই গন্য করা হয় ।  

দ্বিতীয় প্রকারটি হল,- অনুলোম বিবাহ৷ যে বিবাহে স্বামীর বর্ন, বংশ স্ত্রীর চেয়ে উচ্চ বিবর্তিত বা উন্নত। ঋষিরা এই অনুলোম বিবাহকে উচ্চ প্রশংসা করেছেন এবং এর ফলে জন্মানো সন্তানসন্ততি জিনগতভাবে উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে থাকে বলে তাদের পর্যবেক্ষণ। অনুলোমজ সন্তান সমাজের জন্য মংগলপ্রদ। 

কিন্তু, -অনুলোম বিবাহ কখন প্রযোজ্য সেই ব্যাপারে বিধান রয়েছে। প্রাচীনকালে যখন সমাজে যোগ্য ও আদর্শপরায়ন পুরুষের বহুবিবাহ প্রচলন ছিল তখন প্রথম বিবাহ সবর্নে করার পর দ্বিতীয় বা এর পরের বিবাহ অনুলোম বর্নে করার নিয়ম ছিল। কিন্তু বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যাবস্থায় যেহেতু বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, - তাই অনুলোম বিবাহের সুযোগ আর রইল না।   তাই, বর্তমান সমাজব্যাবস্থায় স্ববর্নে-স্ববংশে,- কিন্তু ভিন্ন গোত্রে বিবাহই বিধি। তার আরো একটা কারন হল,- দীর্ঘদিন বর্নাশ্রম পালন না করায় অনেক বর্নের মধ্যেই বিভিন্ন সময় সংমিশ্রণ গঠে গেছে। তাই প্রকৃত বর্নের খোঁজ পাওয়া অনেকসময়ই সম্ভব হয় না৷ তাই ভুলবশতঃ প্রতিলোম  এড়াতে স্ববর্নে-স্ববংশে বিবাহই শ্রেয়। কিন্তু,- গোত্র ভিন্ন হওয়া চাই। যদি কোন বংশে ভিন্ন গোত্র না থাকে,- তবে সেক্ষেত্রে অন্ততঃ দশ পুরুষ অব্দি যাতে কোন বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে রক্তের সম্পর্ক না থাকে,- সেই ব্যাপারে লক্ষ রাখার কথা বলা হয়েছে।  

তারপর আসছে,- বয়স। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন যে বয়সে পুরুষ বায়োলজিকেলি সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে,- সেই বয়সের পার্থক্যটুকু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে থাকা শ্রেয়।  

তারপর আসছে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, কোন বংশগত রোগ আছে কিনা যাচাই করা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পারিবারিক অবস্থা,  স্বভাব ও চরিত্রের সামঞ্জস্য ইত্যাদি।৷

মোটকথা, আমরা যতটা সহজ ও হাল্কাভাবে বিবাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি ঠিক তা নয়৷ অনেক পর্যবেক্ষণ, বিচক্ষনতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন। অথচ,- এমন একটা জটিল ও গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে-পাড়ায়-গলিতে-রাস্তায়-পার্কে-হোটেলে-রেস্টুরেন্টে-বিয়ে বাড়ীতে-পার্টিতে এক লহমার সাক্ষাতে, - আবেগের বশে,শুধু ভালা লাগার ভিত্তিতেই নিয়ে থাকে৷ ফেইসবুকের এডিট করা ছবি দেখে, চ্যাট বক্সের মিথ্যা-বানানো কথা শুনেই কত কত ছেলে মেয়ে আজকাল বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কত কত মেয়ে শাহরুখ খানের মত ন্যাকামিভরা রোমান্টিক ছেলে অথবা সলমান খানের মত মোটা পেশীর ছেলে দেখলেই বিগলিত হয়ে তাকেই স্বামী বলে কল্পনা করে নিচ্ছে। জীবন ও ভবিষ্যতে সম্পর্কে এত ভোঁতা ধারনা নিয়ে সুখী হওয়া অসম্ভব।  অথবা, এরেঞ্জ মেরেজের ক্ষেত্রেও আমরা যে চেহারার সৌন্দর্য, ডিগ্রীর লিস্ট আর ব্যাংক বেলেঞ্চ কে প্রাধান্য দিয়ে থাকি,- সেই ব্যাপারগুলি বিবাহের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অনেক নীচের দিকে বিবেচ্য। অথবা বিবেচ্যই নয়। 

  আবার, শুধুমাত্র বর্ন-বংশ-গোত্র মিলিয়ে বিয়ে করলেই যে সংসার জীবন খুব সুখের ও সার্থক হয়ে যাবে,- তা নয়৷ পুরুষ যদি আদর্শকেন্দ্রিক চলনায় রত না থাকে, জীবন্ত আদর্শের সাথে সক্রিয় ভালবাসার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ইষ্টে যুক্ত না থাকে,- তবে প্রবৃত্তির জালে জড়িয়ে সংসারজীবনে দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত হতে থাকবে। সাথে স্ত্রীকেও জাহান্নামে নিয়ে যাবে।

আবার নারীও যদি কুমারী অবস্থা হতেই ইষ্টকেন্দ্রিক পরিবার ও পবিবেশের মাধ্যমে ইষ্টে যুক্ত হয়ে নিজেকে সংসার জীবনের জন্য প্রস্তুত না করে এবং বিবাহোত্তর জীবনে স্বামীর সাথে ইষ্টকে মূখ্য করে সংসারে চলতে অভ্যস্ত না হয়,- তবে ও সেই একই অবস্থা হতে থাকবে।  

প্রশ্ন আসতে পারে,- এত এত পরিবার সুখে শান্তিতে বসবাস করছে,- সকলেই কি তোমার সেই ইষ্ট আর আদর্শে যুক্ত?হ্যা,-যারাই সাংসারিক জীবনে সুখী ও সফল তারা কোন না কোনভাবে তাদের মত করে ইষ্টনির্দেশ অনুযায়ী আদর্শকে মাথায় নিয়ে চলছে। তাছাড়া,- দুটো বিপরীত লিঙ্গের পশুকে একটি খাঁচায় বন্ধ করে রেখে দিলে,- আর সময় সময় খাদ্য-জল দিলে তারাও সুখে থাকে, সন্তান উৎপন্ন করে, ঘুমায়, আনন্দ করে। আমরা অনেকেই তেমন সুখের সংসারই যাপন করছি। আর সেটাকেই সফলতা ভেবে বেশ আছি। তাই ভাল থাকার বোধ ততটুকুই।