# দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র : ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়া এক দিব্য সম্পর্ক !
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন নির্ভীক আইনজীবী, অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। আরেকদিকে, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে আমরা জানি এক মহামানব, আধ্যাত্মিক গুরু ও সমাজসংস্কারক হিসেবে। কিন্তু বিস্ময়কর সত্য হলো— এই দুই মহান মানুষ এক সময়ে একে অপরের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং সেই সান্নিধ্য দেশবন্ধুর জীবনে এক গভীর রূপান্তর ঘটিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অধ্যায়টি ইতিহাসে চাপা পড়ে গেছে।
বারীন ঘোষের সূত্রে প্রথম পরিচয় :
১৯২৪ সালের প্রেক্ষাপট। সারা দেশ তখন অসহযোগ আন্দোলনের তীব্র জোয়ারে ভাসছে। গান্ধিজী স্বাবলম্বিতার ডাক দিয়েছেন, আর বাংলায় আন্দোলনের প্রধান মুখ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। শারীরিক ও মানসিকভাবে তখন তিনি চরম ক্লান্ত। এরই মধ্যে একদিন তাঁর কাছে কিছু লোক এলেন পাবনার হেমায়েতপুর থেকে। তাঁরা জানালেন— সৎসঙ্গ আশ্রমে একজন মহাপুরুষ আছেন, যাঁর আশ্রয়ে সমাজ-সংস্কার ও নতুন জীবনযাত্রার দিশা খোঁজা হচ্ছে। তাঁরা Wind Power Dynamo নামের একটি যন্ত্রের কথাও বললেন, যা থেকে অনায়াসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
দেশবন্ধু অবাক হয়ে বললেন— “তিনিই কি সেই অনুকূল ঠাকুর, যাঁর কথা বারীনের মুখে শুনেছি ?” বারীন মানে বিপ্লবী বারীন ঘোষ, শ্রীঅরবিন্দের ভাই। আন্দামান থেকে ফিরে বারীন কিছুদিন সৎসঙ্গ আশ্রমে ছিলেন এবং ফিরে এসে দেশবন্ধুর *নারায়ণ* পত্রিকায় “পাবনার মধুচক্র” নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখান থেকেই দেশবন্ধুর মনে ঠাকুরকে নিয়ে প্রবল কৌতূহল জন্মে।
মানিকতলার প্রথম সাক্ষাৎ :
ঘটনাচক্রে তখন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। খবর পেয়ে দেশবন্ধু উত্তেজিত হয়ে ওঠেন— “আজই যাব আমি তাঁর কাছে।” যদিও রাজনৈতিক কাজের কারণে সেদিন আর যেতে পারেননি, তবে পরদিনই মানিকতলার একটি বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
দেশবন্ধু ভেবেছিলেন— ঠাকুর বুঝি জটাজুটধারী, গেরুয়া বসন পরা কোনো সন্ন্যাসী ধরনের মানুষ হবেন। অথচ এসে দেখলেন— একজন যুবক বয়সী, গৌরবর্ণ, আজানুলম্বিত বাহু, ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক দিব্য পুরুষ। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৩৬। ঠাকুর সস্নেহে দেশবন্ধুকে মাদুরে বসালেন। শুরু হলো দীর্ঘ আলাপ।
কথা হলো দেশের রাজনীতি, স্বরাজ, সমাজসংস্কার, পল্লিউন্নয়ন, শিক্ষা ও মানবসম্পদ নিয়ে। দেশবন্ধু নিজের মনের দুঃখ প্রকাশ করলেন— “যার উপর ভার দিই, সে-ই বিশ্বাসঘাতক হয়। স্বরাজের পথে সাহায্যকারী পাচ্ছি না।” ঠাকুর শান্ত গলায় বললেন— “আপনারা আগে মানুষ তৈরি করছেন না। অথচ মানুষ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র গড়া যায় না। সমাজ সংস্কার ছাড়া স্বরাজ কেবল কাগজে থাকবে।”
দেশবন্ধুর দীক্ষা :
সেই রাতে দেশবন্ধুর জীবনে ঘটল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে দীক্ষা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন। ঠাকুর নিজে দীক্ষা দিতেন না, তাই তাঁকে মাতৃদেবী মনমোহিনী দেবীর কাছে পাঠালেন। উন্মুক্ত আকাশের নীচে, প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে ১৯২৪ সালের ১৪ মে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে গুরু হিসেবে বরণ করলেন।
হেমায়েতপুরে দেশবন্ধু :
দীক্ষা গ্রহণের এক বছর পর, ১৯২৫ সালের মে মাসে, দেশবন্ধু স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে হেমায়েতপুর সৎসঙ্গ আশ্রমে আসেন। পদ্মাতীরের শান্ত পরিবেশ, আশ্রমের আধ্যাত্মিক আবহ— সব মিলিয়ে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। কয়েকদিন আশ্রমে অবস্থানকালে তিনি প্রায় প্রতিদিনই ঠাকুরের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা চালাতেন। আলোচনার বিষয় ছিল সমাজসংস্কার, সাহিত্য, ইতিহাস, শিক্ষা, পল্লি উন্নয়ন।
ব্রজগোপাল দত্তরায় লিখেছেন— দেশবন্ধু এমনকি পরিকল্পনা করেছিলেন আশ্রমের কাছে একটি বাড়ি কিনে সেখানে থেকে জীবন কাটাবেন। একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে ঠাকুরের আদর্শ প্রচার করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস— শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁকে দার্জিলিঙে চিকিৎসার জন্য যেতে হলো।
গান্ধিজীর কাছে গুরুর প্রসঙ্গ :
দার্জিলিঙে অসুস্থ দেশবন্ধুর সঙ্গে গান্ধিজী যখন সাক্ষাৎ করেন, দেশবন্ধু তখন গান্ধিজিকে বারবার বললেন— “আমার গুরু আমাকে নতুন শক্তি দিয়েছেন, যা আগে কখনো ছিল না।” গান্ধিজি বিস্মিত হলেন, এবং “Young India” পত্রিকায় লিখলেন—
*“I have learnt from my Guru the value of truth… He has given me strength I did not possess before. I see things clearly which I saw dimly before.”*
অর্থাৎ দেশবন্ধু তাঁর গুরু শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের প্রসঙ্গ গান্ধিজীকেও শুনিয়েছিলেন, এবং তাঁকে সৎসঙ্গ আশ্রমে কিছুদিন থাকার অনুরোধ করেছিলেন।
মৃত্যুশয্যায় ঠাকুরের নাম :
১৬ জুন ১৯২৫। দেশবন্ধু গুরুপ্রদত্ত *“নাম”* উচ্চারণ করতে করতে দেহত্যাগ করেন। তাঁর জীবনীকার হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখেছেন— “তিনি মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ঠাকুরের নাম জপ করে গেছেন।” এমনকি তাঁর শ্রাদ্ধসভায় তাঁর ছবির পাশে শ্রীশ্রীঠাকুরের ছবিও পূজিত হয়েছিল।
কেন আড়াল হলো এই অধ্যায় ?
প্রশ্ন জাগে— এত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কেন ইতিহাসের মূল স্রোতে আলোচিত হয়নি ? সম্ভবত কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁকে কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নায়ক হিসেবেই স্মরণ করেছে। তাঁর আধ্যাত্মিক দীক্ষা ইতিহাস রচয়িতাদের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। দ্বিতীয়ত, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে ঘিরে তখনো যথেষ্ট প্রচার ছিল না। ফলে এই অধ্যায়টি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে গেছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো— দেশবন্ধুর জীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁর মানসিক রূপান্তর, আধ্যাত্মিক শান্তি ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজ ইতিহাসের পাতা থেকে ধুলো সরিয়ে দেখা দরকার— দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ শুধু এক রাজনৈতিক নায়কই নন, তিনি ছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্য। তাঁর জীবনের অন্তিমকালীন মানসিক প্রশান্তি, আধ্যাত্মিক চেতনা এবং মৃত্যুশয্যায় গুরুর নাম উচ্চারণ— সবই প্রমাণ করে এই সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল।
যদি এই সত্য আরও আরও বেশি করে আলোচিত হতো, তবে হয়তো আমরা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে শুধু আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেই নয়, বরং জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য প্রেরণাদাতা হিসেবেও দেখতাম। আজ সময় এসেছে এই আড়াল করা অধ্যায়কে আলোয় আনার— যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে, কেমন করে এক আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ এক জাতীয় নেতার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।