Blessings of Harichand - 2 in Bengali Motivational Stories by SAKTI BISWAS books and stories PDF | হরিচাঁদের আশীর্বাদ - 2

Featured Books
  • The Glory of Life - 5

    પ્રકરણ 5 : એક વખત એક માણસ પોતે પોતાના જીવન માં સર્વસ્વ ત્યાગ...

  • તલાશ 3 - ભાગ 56

    ડિસ્ક્લેમર : આ એક કાલ્પનિક વાર્તા છે. તથા તમામ પાત્રો અને તે...

  • જીવન પથ - ભાગ 29

    જીવન પથ-રાકેશ ઠક્કરભાગ-૨૯         એક ભાઈ પૂછે છે,‘માણસ જીવનમ...

  • એકાંત - 26

    હાર્દિકની પત્ની રિંકલની જોબ પાટણ ટ્રાન્સફર થઈ ગઈ. હાર્દિકે પ...

  • તણાવમુક્ત પરીક્ષા

    પુસ્તક પરિચય : મારી વહાલી પરીક્ષાલેખક : ડૉ. નિમિત ઓઝાપ્રકાશક...

Categories
Share

হরিচাঁদের আশীর্বাদ - 2


অধ্যায় ২: অবহেলার কষ্ট

ঠাকুরনগরের ভোর মানেই মাটির গন্ধে ভেজা হাওয়া, দূরে ধানক্ষেতের সবুজ ছায়া আর পাখির কিচিরমিচির। কৃষ্ণপদর বয়স তখন সাত। তার মায়ের চোখে ভোরের আলোয় অদ্ভুত স্বপ্ন—“আমার ছেলে পড়াশোনা শিখবে, মানুষের মতো মানুষ হবে।”
সেদিন ছিল কৃষ্ণপদের জীবনের এক বিশেষ দিন—স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিন।
মা আগের রাতে সেলাই করে দিয়েছিলেন একখানা পুরনো জামা, যদিও তাতে ফাটা জায়গা সুঁই-সুতোয় বোনা। পিঠে একটি টিনের বাক্স, ভেতরে মাত্র দুটো খাতা আর একটি ভাঙা পেন্সিল। বাবার হাতে সামান্য টিফিন—ভাতের সাথে শুকনো আলুর চচ্চড়ি।
মা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন—
“যা রে বাবা, পড়াশোনা শিখবি। তোর জীবন যেন আমাদের মতো না হয়।”
কৃষ্ণপদ লজ্জা আর উত্তেজনার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিল। তার ছোট্ট বুক কাঁপছিল আনন্দে—“আজ আমি স্কুলে যাব, অক্ষর শিখব।”
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টা কাঁচা ইটের তৈরি, টিনের ছাউনি। দরজায় পৌঁছাতেই কয়েকজন ছেলে ফিসফিস করে বলল—
“ওই দেখ, মতুয়ার ছেলে এসেছে।”
তাদের চোখেমুখে উপহাস, ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি।
কৃষ্ণপদ থমকে গেল। সে তো কিছু ভুল করেনি, শুধু স্কুলে পড়তে এসেছে। তবু কেন এই কটাক্ষ?
ক্লাসে ঢুকে সে বেঞ্চে বসতে চাইলে দু’একজন বলল—
“এখানে বসিস না, ওই কোণের বেঞ্চে যা।”
কৃষ্ণপদ মুখ নিচু করে চলে গেল। শিক্ষক কিছু বলেননি, শুধু চোখ তুলে একবার তাকালেন, তারপর আবার খাতায় মন দিলেন।
পাঠ চলছিল। অক্ষর লিখতে বলা হলো। কৃষ্ণপদ নিজের খাতায় যত্ন করে লিখছিল। হঠাৎ পাশের বেঞ্চের এক ছাত্র খাতার দিকে তাকিয়ে বলল—
“তোর খাতা এত ময়লা কেন? তোদের ঘর কি কাদা-মাটির নয়?”
ক্লাসে হেসে উঠল কয়েকজন।
কৃষ্ণপদর বুকটা ধক করে উঠল। সে বুঝল, পড়াশোনার জায়গাতেও তার জন্মপরিচয় যেন তাকে তাড়া করছে।
বাড়ি ফিরে সে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল—
“মা, ওরা আমাকে বসতে দেয়নি, হেসেছে, বলেছে আমি মতুয়া।”
মা তাকে কোলে টেনে নিলেন, মুছিয়ে দিলেন অশ্রু।
“শোন বাবা, মতুয়া মানে খারাপ নয়। মতুয়া মানে মানবধর্ম। হরিচাঁদ ঠাকুর শিখিয়েছেন, মানুষ ভেদে ছোট-বড় নয়, কর্মে বড়। মনে রাখিস, তোকে যে অপমান করছে, সে নিজেই অজ্ঞ।”
মায়ের কথা শুনে কৃষ্ণপদর চোখ শুকিয়ে গেল। বুকের ভেতরে নতুন এক আগুন জ্বলে উঠল। সে ভাবল—
“আমি পড়াশোনা শিখব, প্রমাণ করব আমি কারো চেয়ে কম নই।”

কৃষ্ণপদ নিয়মিত স্কুলে যেত। যতই অবহেলা আসুক, তার মনে ছিল এক অদম্য ইচ্ছা—শিক্ষা নিতে হবে, বই পড়তে হবে।
প্রথম দিকে অক্ষর লেখা, ছোট ছোট গল্প পড়া – সবকিছুই তার কাছে ছিল আনন্দের। কিন্তু ধীরে ধীরে সে টের পেল, শিক্ষার ভেতরও যেন অদৃশ্য এক দেওয়াল আছে।
গণিত ক্লাসে শিক্ষক প্রশ্ন করলেন—
“কেউ কি বলতে পারবে, সাত গুণে পাঁচ কত হয়?”
সারা ক্লাস চুপ। কৃষ্ণপদ হাত তুলল, গলা কাঁপছে উত্তেজনায়
“স্যার, পঁইত্রিশ।”
শিক্ষক উত্তর শুনলেন, কিন্তু কোনো প্রশংসা করলেন না। বরং পাশের বেঞ্চে বসা এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, যেটা সে উত্তরই দিতে পারল না। তবু শিক্ষক মৃদু হাসলেন আর বললেন—
“চেষ্টা করেছিস, খুব ভালো।”
কৃষ্ণপদর বুকটা কেঁপে উঠল। তার মনে হলো—শিক্ষকের চোখে সে যেন অদৃশ্য।
একবার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় কৃষ্ণপদ সব প্রশ্ন ঠিকঠাক লিখল। খাতা জমা দেওয়ার সময় সে মনে মনে গর্ব অনুভব করল—“আজ আমি প্রমাণ করব।”
ফল প্রকাশের দিন ক্লাসে নাম ডাকা হলো। প্রথম স্থান পেল পাশের ছেলেটি, যে অনেক উত্তরই লিখতে পারেনি। কৃষ্ণপদর খাতায় ভুল খুব কম ছিল, তবু তাকে তৃতীয় করা হলো।
সে সাহস করে শিক্ষককে বলল—
“স্যার, আমার খাতায় তো সব ঠিক আছে। আমি কেন তৃতীয়?”
শিক্ষক কঠিন গলায় বললেন—
“চুপ করে বস, বেশি কথা বলিস না। নম্বর আমি যেমন দিয়েছি তেমনই থাকবে।”
ক্লাসে হাসাহাসি শুরু হলো। কৃষ্ণপদ মাথা নিচু করে বসে রইল। তার মনে একটাই প্রশ্ন—
“শিক্ষা কি তবে সবার সমান নয়? আমি কি শুধু মতুয়া বলেই পিছিয়ে পড়ব?”
স্কুলের মাঠে খেলাধুলোতেও বৈষম্য ছিল। ফুটবল খেলতে নামলে তাকে প্রায়শই বাইরে বসিয়ে রাখা হতো।
একদিন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ব্যাট হাতে নিতেই কয়েকজন বলল—
“তুই ফিল্ডে দাঁড়া, খেলতে হবে না।”
কৃষ্ণপদর চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। তার ভেতরে এক অদ্ভুত নীরব আগুন জমে উঠল।
দিনে দিনে সে বুঝল, তাকে সবার মতো জায়গা দেওয়া হবে না। তাই সে রাত জেগে পড়াশোনা শুরু করল। বই যেন তার একমাত্র বন্ধু হয়ে উঠল।
মায়ের দেওয়া পুরনো প্রদীপের আলোয় সে অক্ষর চর্চা করত, ইতিহাস পড়ত। মনে মনে বলত—
“একদিন আমি পড়াশোনায় এমন হব যে সবাই আমাকে মানতে বাধ্য হবে।”
কৃষ্ণপদ প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করত—
“হরিচাঁদ ঠাকুর, কেন আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ হয়? আমরা কি মানুষ নই?”
কিন্তু সাথেসাথেই তার বুকের ভেতর থেকে এক শক্তি উঠে আসত—
“না, ভেঙে পড়া চলবে না। অপমানকে জ্বালানী করে জ্বালতে হবে।”
কৃষ্ণপদর গ্রাম ঠাকুরনগর। গ্রামটি ছোট হলেও জীবনযাপন ছিল কষ্টকর। মাটির ঘর, কাঁচা রাস্তা, পুকুরের জলে গোসল আর ধানক্ষেতে কাজ করে জীবনধারণ। অধিকাংশ মানুষই মতুয়া পরিবার। তাদের জীবনের কেন্দ্র ছিল ঠাকুরবাড়ি, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নামসংকীর্তন হতো।

কৃষ্ণপদ ছোট থেকেই সেই কীর্তনের সুরে বড় হয়েছে। কিন্তু গ্রামের বাইরের দুনিয়ায় তাদের পরিচয় এক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বাজারে গেলে কৃষ্ণপদ প্রায়ই শুনত কটূক্তি—
“ওরা মতুয়া, এদের সঙ্গে বেশি মিশিস না।”
কোনো দোকানে গিয়ে বসতে চাইলে কেউ কেউ মুখ বাঁকিয়ে বলত—
“ওইদিকে দাঁড়া, এখানে বসিস না।”
পাড়ার উৎসবে যখন নাটক বা গান হতো, কৃষ্ণপদ অংশ নিতে চাইত। কিন্তু আয়োজকেরা বলত—
“না না, তোদের জায়গা অন্যখানে। তোরা দর্শক হয়ে থাক।”
তখন তার ভেতরে এক অদ্ভুত কষ্ট জমে উঠত। সে বুঝতে পারত না, যে মানুষ নামসংকীর্তনে সবাইকে সমান ভাবে ডাকে, তারাই কেন বাস্তব জীবনে তাকে আলাদা করে রাখে।
একবার গ্রামের এক আত্মীয়ের বিয়েতে কৃষ্ণপদ গিয়েছিল। বিয়ের ঘরে খাওয়ার সময় দেখা গেল, মতুয়া পরিবারদের জন্য আলাদা পাত বসানো হয়েছে, অন্য অতিথিদের থেকে দূরে।
কৃষ্ণপদ মাকে জিজ্ঞেস করল—
“মা, আমাদের আলাদা বসতে হলো কেন?”
মা হেসে বললেন, যদিও চোখে ছিল দুঃখ—
“এটাই রীতি রে বাবা। মানুষ ভেদাভেদ করে।”
কৃষ্ণপদর মনে প্রশ্ন জেগে উঠল—
“ধর্মে আমরা সবাই সমান, তবু কেন সমাজ আমাদের আলাদা করে?”
একবার কৃষ্ণপদ তার বাবার সঙ্গে পাশের গ্রামে গিয়েছিল ধান কাটতে। কাজ শেষ হলে মজুরি দেওয়ার সময় জমিদার মুখ বাঁকিয়ে বলল—
“তোরা মতুয়া, তোমাদের ক’টা টাকা কম দিলেও ক্ষতি নেই।”
বাবা মাথা নিচু করে টাকা নিয়ে নিলেন। কৃষ্ণপদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—
“বাবা, তুমি প্রতিবাদ করলে না কেন?”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—
“যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তা একদিনে বদলাবে না রে। কিন্তু তুই যদি শিক্ষিত হোস, তোর প্রজন্ম হয়তো অন্যরকম হবে।”
এই কথাগুলো কৃষ্ণপদর মনে অমোচনীয় দাগ কাটল।

দিন দিন কৃষ্ণপদ বুঝতে পারল, শুধু স্কুল নয়, গ্রামের প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি ঘটনায় বৈষম্য লুকিয়ে আছে।
খেলাধুলো থেকে শুরু করে উৎসব, কাজ থেকে শুরু করে সামাজিক আসর—সব জায়গায় যেন অদৃশ্য দেওয়াল।
তবুও তার ভেতরে এক ধরনের দৃঢ়তা জন্ম নিচ্ছিল। সে ভাবত—
“যদি আমি হাল ছেড়ে দিই, তবে এই অবস্থা চিরকাল চলবে। আমাকে দাঁড়াতেই হবে।

তবে এই অন্ধকারের মাঝেও আলো ছিল। গ্রামের ঠাকুরবাড়ির কীর্তনে যখন সবাই একসাথে গাইত—
“হরিবোল… জয় হরিচাঁদ…”
তখন কৃষ্ণপদ অনুভব করত, এই বৈষম্য একদিন ভেঙে যাবে।
তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল—
“হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের বাণী একদিন এই অন্ধকার কাটাবে। আমি সেই দিনের জন্য লড়াই করব।”
গ্রামের মানুষের অবহেলা, স্কুলের শিক্ষকের পক্ষপাত, বন্ধুদের কটুক্তি—সব মিলিয়ে কৃষ্ণপদর মন প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল।
প্রতিদিন সে বুকের ভেতরে জমে থাকা প্রশ্ন নিয়ে ঘরে ফিরত
“আমি কি দোষ করেছি? আমি কেন আলাদা?”
এক সন্ধ্যায় কৃষ্ণপদ চুপচাপ দরজার সামনে বসে ছিল। আকাশে তখন লাল আভা, পাখিরা ফিরছে বাসায়। মা এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“কি রে, এমন চুপচাপ কেন?”
কৃষ্ণপদ চোখ ভিজে বলল—
“মা, ওরা আমাকে সব জায়গায় অবহেলা করে। স্কুলে বসতে দেয় না, খেলতেও দেয় না। বাজারে গেলে হাসাহাসি করে। আমি কি মানুষ নই?”
মা গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন—
“শোন বাবা, তুই মানুষ, আর মানুষের ধর্ম হলো মানবধর্ম। হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছিলেন—‘জাত দিয়ে নয়, কাজ দিয়েই মানুষ বড় হয়।’ যারা তোকে ছোট করে দেখে, তারা অজ্ঞ। তুই তাদের মতো অন্ধ হবি না। তুই আলো খুঁজ।”
মায়ের চোখে জল ছিল, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা। কৃষ্ণপদ বুঝল—তার মা দুঃখ লুকিয়েও তাকে শক্ত করে তুলতে চাইছেন।

সেই রাতে কৃষ্ণপদ একা শুয়ে অনেক ভাবল।
একদিকে সে কষ্টে ভেঙে পড়ছিল, অন্যদিকে মনে হচ্ছিল—“আমি যদি হার মানি, তবে সমাজের এই অন্যায় চলতেই থাকবে।”
তার বুকের ভেতরে যেন দুটি কণ্ঠ যুদ্ধ করছিল।
একটা কণ্ঠ বলছে—
“হাল ছেড়ে দে, কিছুই বদলাবে না।”
আরেকটা কণ্ঠ বলছে—
“না, তুই লড়। শিক্ষা আর সাহসই তোর অস্ত্র।”

রাত গভীর হলো। প্রদীপের আলোয় খাতা খুলে বসলো কৃষ্ণপদ। লিখল কয়েকটা শব্দ—
“আমি প্রমাণ করব, মতুয়া মানে ছোট নয়।”
তার মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জন্ম নিল।
সে জানল, সমাজ তাকে যতই অবহেলা করুক, সে শিক্ষা থেকে সরে আসবে না। একদিন সে আলো ছড়াবে, যেভাবে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজের অন্ধকার ভেঙেছিলেন।

ঠিক সেই সময় দূর থেকে ভেসে এল ঠাকুরবাড়ির নামসংকীর্তন—
“হরিবোল… জয় হরিচাঁদ… জয় গুরুচাঁদ…”
কৃষ্ণপদর বুক কেঁপে উঠল। মনে হলো, এই সুর যেন তাকে আশীর্বাদ দিচ্ছে।
সে মনে মনে বলল—
“আমিও একদিন এই সুরের মতো মানুষের মনে আলো ছড়াব। আমাকে আর কেউ থামাতে পারবে না।”
স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিনের মতো কৃষ্ণপদ মাঠের এক কোণে বসে রইল। অন্য ছেলেরা ফুটবল খেলছে, দৌড়ঝাঁপ করছে, হাসাহাসি করছে।
কৃষ্ণপদ তাদের দিকে তাকালেও কাছে যায় না। গেলেই হয়ত ঠাট্টা করবে—
“মতুয়ার ছেলে আমাদের দলে খেলবে না।”
মনের ভেতরে যন্ত্রণা চেপে ধরে সে একা বসে থাকল।

সেই সময় গ্রামের বাইরের দিক থেকে এক ছেলে মাঠে এল। নাম তার সুবল। সে অন্য গ্রাম থেকে মামার বাড়ি এসেছে।
খেলা দেখতে দেখতে সুবল কৃষ্ণপদের কাছে এসে বলল—
“তুই খেলছিস না কেন?”
কৃষ্ণপদ মাথা নিচু করে বলল—
“আমাকে কেউ দলে নেয় না। আমি মতুয়া বলে সবাই দূরে থাকে।”
সুবল হেসে উত্তর দিল—
“ওরা যদি না নেয়, তাহলে আমরা দু’জনে খেলব। ফুটবলটা কাকে বলে শুধু দলেই খেলতে হয়? একসাথে দৌড়ালেও তো খেলা।”
কৃষ্ণপদ বিস্ময়ে তাকাল। এতদিনে প্রথম কেউ তাকে এভাবে ডাকল!

দু’জনে আলাদা কোণে দাঁড়িয়ে বল নিয়ে খেলতে শুরু করল। অন্যরা খেলা থামিয়ে তাদের দিকে তাকাল।
কারো ঠোঁটে বিদ্রুপ, কারো চোখে অবজ্ঞা। কিন্তু কৃষ্ণপদর মনে হলো, সে একা নয়।
খেলতে খেলতে সুবল বলল—
“মানুষকে ধর্ম বা জাত দিয়ে নয়, কাজ দিয়ে বিচার করা উচিত। আমি তোকে মানুষ হিসেবে দেখি।”
কৃষ্ণপদের বুকের ভেতর যেন আলো জ্বলে উঠল।

খেলা চলাকালীন হঠাৎ বলটা গড়িয়ে গেল পুকুরের ধারে। মাঠের ছেলেরা চেঁচিয়ে বলল—
“যাবি না! ওখানে সাপ থাকতে পারে।”
কিন্তু কৃষ্ণপদ দৌড়ে গেল। বলটা উঠিয়ে আনল আর হেসে বলল—
“ভয় পেলে কিসের খেলা?”
সেই মুহূর্ত যেন প্রতীক হয়ে রইল—
কৃষ্ণপদর জীবনও অনেক বাধা-অবজ্ঞায় ঘেরা, কিন্তু সাহস থাকলে সব জয় করা যায়।

সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে কৃষ্ণপদ ভাবল—
“আমি যদি একাই লড়ি, তবে হয়ত ক্লান্ত হব। কিন্তু যদি একজনও পাশে থাকে, তবে আমি হারব না।”
সুবলের ছোট্ট বন্ধুত্ব তার মনের আকাশে একটুখানি রোদ্দুর ছড়িয়ে দিল।