শ্বেতার পুরো পৃথিবীটা যেন ঘুরতে শুরু করেছিল। ফোনের ওপারে সেই নির্লিপ্ত, শীতল কণ্ঠস্বর। রাজীব! যে মানুষটাকে সে ঘৃণা করে, যে মানুষটা কারণে-অকারণে তাকে অপমান করে, সেই মানুষটাই এখন তার মায়ের জীবনের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্বেতার রক্ত গরম হয়ে ওঠে। ঘৃণা, ক্রোধ আর অসহায়তা একসঙ্গে মিলেমিশে এক ভয়ংকর অনুভূতি তৈরি হয়।
"আপনি কি বলছেন, স্যার? আপনার মতো একজন মানুষ, যিনি নিজের কর্মীদের সামান্য সম্মানও করেন না, তিনি আমার মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নিচ্ছেন?" শ্বেতার গলা কাঁপছিল, "আর তার বদলে আমি আপনার জন্য... বিয়ে করব? অভিনয় করব? এটা কি কোনো ধরনের রসিকতা?"
রাজীবের দিক থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না। কিছুক্ষণ পর সে শান্ত গলায় বলল, "এটা কোনো রসিকতা নয়, মিস সেন। এটা একটা চুক্তি। আপনার মায়ের চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ টাকা দরকার, তা আপনার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। আপনি ভালো করেই জানেন, একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এমন খরচ সামলানো কতটা কঠিন। আর আমার দাদু অসুস্থ। মৃত্যুর আগে তিনি আমার বিয়ে দেখতে চান।"
শ্বেতা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এই মানুষটা কি এতটাই নিষ্ঠুর হতে পারে? যে তার ব্যক্তিগত কষ্টকে এভাবে ব্যবহার করতে চাইছে?
"আমার মা... আমার মা মারা যাচ্ছেন," শ্বেতা ফিসফিস করে বলল, তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। "আর আপনি এটাকে নিজের সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করছেন? আপনার কি লজ্জা করে না?"
"লজ্জা?" রাজীবের গলা এবার একটু উঁচুতে উঠল। "আমি আপনার মতো দুর্বল নই, মিস সেন। আবেগ আমার কাছে অর্থহীন। আমি বাস্তববাদী। আমি আমার দাদুর ইচ্ছা পূরণ করতে চাই, আর আপনি আপনার মায়ের জীবন বাঁচাতে চান। এটা একটা লেনদেন, একটা চুক্তি।"
রাজীবের এই অমানবিক কথায় শ্বেতা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে, যেখানে তার সামনে কোনো পথ খোলা নেই। একদিকে তার মায়ের জীবন, অন্যদিকে নিজের সম্মান আর ঘৃণা। সে জানত, যদি সে এই চুক্তি মেনে নেয়, তবে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নরকের মতো হবে। রাজীবের কাছাকাছি থাকা, তার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করা... এটা ভাবতেই তার গা শিউরে উঠছিল।
"আমাকে একটু সময় দিন, স্যার," শ্বেতা কোনোমতে বলল। "আমি আপনাকে কাল সকালে জানাব।"
"না, মিস সেন," রাজীবের গলা আরও কঠোর শোনাল, "আপনার কাছে সময় নেই। আপনার মায়ের চিকিৎসার জরুরি কাগজপত্র আমার হাতে আছে। আপনি এক সপ্তাহের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করবেন এবং চুক্তিতে সই করবেন। অথবা... আপনার মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব আমি আর নেব না।"
ফোন কেটে গেল। শ্বেতা ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলল। সে একমুহূর্তের জন্য সব ভুলে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে চাইল। কিন্তু তার মায়ের মুখটা মনে পড়তেই সে নিজেকে সামলে নিল। মায়ের জীবন এখন তার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। তার সামনে শুধু দুটো পথ—হয় ঘৃণ্য রাজীবের সঙ্গে অভিনয় করে মায়ের জীবন বাঁচানো, অথবা নিজের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে মাকে হারানো।
পরের দিন সকালে, শ্বেতা সিদ্ধান্ত নিল। সে রাজীবের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু সে রাজীবকে এমন সহজে ছেড়ে দেবে না। সে এই চুক্তিতে সই করবে, কিন্তু তার বিনিময়ে রাজীবের জীবনটাও সে কঠিন করে তুলবে। শ্বেতা তার মায়ের কাছে গেল। তার মায়ের হাতে হাত রেখে বলল, "মা, তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে কিছু হতে দেব না। আমি তোমার জন্য সব করব।"
শ্বেতার মনে তখন রাজীবের মুখের ছবি ভেসে উঠল। তার চোখে তখন এক নতুন দৃঢ়তা। সে ঘৃণা করে রাজীবকে, কিন্তু এই ঘৃণাই তাকে শক্তি দেবে। সে এই চুক্তিতে সই করবে, তবে নিজের শর্তে। সে এই খেলায় নেমেছে। এবং সে এই খেলাটা জিতবেই। কিন্তু... এই খেলাটা কি এতটাই সহজ হবে? এই চুক্তির ভালোবাসা কি শুধু অভিনয় থাকবে, নাকি কোনো এক সময় বাস্তব হয়ে উঠবে?
চলবে……