বাসন্তী নদীর পাড়ে শিমুল নামের গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা পাকা বাড়িতে সনাতনী ধর্মের দুই মা মেয়ের বাস।বাড়ির যেনো আলাদাই এক সৌন্দর্য্য আছে, চারিদিকে সন্ধ্যামালতি,টগর,জুই, জবা ,বেলিফুলের গাছ এছাড়াও নারকেল,নিম, কাঁঠাল, আম গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়িটা।বাড়ির সামনে বাগানবিলাসি ফুলগাছটা গেটের কাজ করে যেনো।মায়ের নাম বাসন্তী আর মেয়ের নাম ফুলবানু মেয়ের এই নাম রাখার পিছনে একটা রহস্যও আছে যেনো।একরাতে শুয়ে ছোট্ট ফুলবানু জিজ্ঞেস করে মা তোমার নাম বাসন্তী কেনো ? কে রেখেছিল এই নাম?। সেদিন বাসন্তী হেসে বলে সে এক বিরাট কাহিনী বর্ষায় জলে নদী তখন ফুলেফেঁপে উঠে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে যেনো ,সেবার চাষবাস খুব ভালো হয় গ্রামবাসীর ।মাঠে মাঠে ধান গাছ বাতাসের তোরে নেচে উঠছে যেনো। এইরকম এক দিনে তোমার দিদুনের প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কোনো জনমানব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, দাইমা ডাকার মতোন অবস্থা ছিল না তাও তোমার দাদু মানে আমার বাবা দাইমা আনতে বের হয় । কিন্তু ঈশ্বরের কি লীলা বের হওয়ার সময় তিনি দেখেন একজন বৃদ্ধা বৃষ্টির তোড়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের বাড়িতে আসে আশ্রয়ের জন্য। বাবা তাকে আশ্রয় দেয় ,সেইসময় ওই বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছো বাবা? এই তুমুল বৃষ্টির দিনে বাইরে একটা কাকপক্ষীও নেই তুমি এখন বেরোলে বিপদে পড়বে। তখন মায়ের চিৎকার শুনে বাবা বলে আমাকে এখনই যেতে হবে দাইমা আনতে আমার স্ত্রী প্রসব যন্ত্রণা হচ্ছে । বৃদ্ধা বলে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না তুমি গরম জল , গামলা,আর কিছু কাপড়ের ব্যবস্থা করে দাও সাথে একটা ছুরি বা ব্লেট তোমার স্ত্রীর বাচ্চা হওয়ার ব্যবস্থা করবো আমি তুমি আমাকে এই ঝড় বৃষ্টির দিনে আশ্রয় দিয়েছো এই কাজ আমি পারি যেখানে সেখানে তোমার উপরকারের এইটুকু প্রতিদান দিতে দাও। বাবা শুনে খুশি হয়ে সকল ব্যবস্থা করে দেন এবং ওই বৃদ্ধার হাত দিয়ে এক মেয়ে বাচ্চার ভূমিষ্ঠ হয়। সেই বাচ্চাটিকে তিনি হাতে নিয়ে একগাল হেসে বললেন ও বৌ তোর ঘরে মা বাসন্তী আইলো রে। বাবা মা দুই বড় ছেলের পর এই বয়সকালে মেয়ে হওয়ায় খুশি হয়ে বাচ্চাটির নাম বাসন্তী রাখলেন । মুচকি হেসে বাসন্তী বললো।
মা মা ওটা তুমি ছিলে একরাশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল ফুলবানু।
মুচকি হেসে বাসন্তী বললো হ্যাঁ রে মা ওটা আমি ছিলাম ,আচ্ছা আর কোনো কথা নই এখন ঘুমা কালকে থেকে স্কুলে যাবি মনে আছে?
হ্যাঁ মনে আছে তো অনেক বন্ধু হবে আমার ,অনেক পড়াশোনা করবো, আমাকে অনেক বড়ো ডাক্টার হতে হবে যে,তারপর আমিও সবার চিকিৎসা করে সব রোগ ফু দিয়ে উড়িয়ে দেবো তাই না মা একরাশ উচ্ছাস নিয়ে বললো ফুলবানু । হ্যাঁ হ্যাঁ আমার সোনা মা ফু দিয়ে চিকিৎসা করে সবার রোগ সারিয়ে দেবে হেঁসে বললো বাসন্তী ।এতটুকুনি মেয়ের চোখে উপছে পরা স্বপ্ন দেখতে পেলো বাসন্তী সেটা কি আদেও পূরণ করতে পারবে নাকি তাঁর মতো হারিয়ে যাবে একসময়। মেয়েটার চোখে সে চেনা কারোর প্রতিচ্ছবি পাই যেনো রোজ এইভেবে তার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বেরোলো।বাসন্তীর ও খুব ইচ্ছা ছিলো পড়শোনা করে অনেক বড় ডাক্তার হওয়ার কিন্তু বাবা মায়ের শেষ বয়সের সন্তান ছিল সে । তার দুই ভাই তার থেকে অনেক বড়ো ছিল ,বাবা মা যখন তাকে ছেড়ে যায় তখন কতই বা বয়স ছিল তার ? মাত্র আট বছর। ওইটুকু বয়সে সে বাবা মা হারা হয়। দাদারা তখন বিয়ে করে নিজেদের সংসার সামলাচ্ছে। ছোট্ট বাসন্তীর তখন একবার বড়দা তো একবার ছোটদার ঘরে ঠাঁই হতো ,মাস পালা করে রাখতো তাঁরা, ছোট্ট বোনের জন্য তাদের মনে তেমন কোন টান বা ভালোবাসা ছিলো না যেনো। বৌদিদিদের কাছে কত যে মার-লাথি- ঝেঠা খেয়েছে একটু পড়াশোনার জন্য তার ঠিক আছে তারা যে চাইতই না সে পড়ুক,বাড়িতে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারতো না,বললেই যেনো তার বউদিরা বুঝতেই পারে না তাদের জন্য তাকেও ওদের সাথে গ্রামমো ভাষায় কথা বলতে হতো, পড়তে দেখলেই মুখ বেঁকিয়ে বলতো " তা ও বাচন্তি পোলাসোনা কলে কি হবি লো ? বেলিস্টার? না দিদিমনি ? কিছুই তো হতে পারবি না লো খালি খালি মুর শোয়ামির ঠেহা পয়সা নষ্ট করে ছেরি? সেই তো মুখপুরীর বে করে শোয়ামীর সংসার সামলাবি বলি ঘরের কাজ কাম শেখ"। ছোট থেকেই বাসন্তীর পড়াশোনায় খুব ঝোঁক ছিল। কোনো কাগজ পেলেই সে পড়তে চাইতো তার আগ্রহ দেখে তার বাবা তাকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। কি যে সোনালী সময় ছিল তখন । মা সুন্দর করে চুল বেঁধে খাইয়ে দিত আর বাবার হাত ধরে সে স্কুলে যেতো মেঠো পথ ধরে,স্কুলে পড়াশোনা ভালো ছিল খুব সে আর তার এক বান্ধবী ,স্কুলের স্যার ও দিদিমনিদের চোখে তাদের নিয়ে কত আশা ছিল তাদের নিয়ে , স্কুলের প্রাঙ্গণে সে আর তার বান্ধবী কত যে খেলতো তার কোনো ঠিক নেই আহা কি যে মিষ্টি দিন ছিল । তারপর হঠাৎ ক্যান্সারে মা মারা গেলো সেই শোকে পরের মাসে বাবা মারা গেলো। দাদারা ভালো না বাসলেও ফেলেও দেইনি তাকে। বউদিদিদের হাতে হাতে কাজ করে দিতে দিতে কাজেও পারদর্শী হয়ে গিয়েছিল ছোট থেকেই। চোখে তার কত স্বপ্ন ছিল। দাদা বৌদিরা বেশি পড়তেই দিলো না মেট্রিক পরীক্ষার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। মানুষটা খুব ভালো ছিল শুধু সেই মানুষটা না সাথে শাশুড়িও খুব ভালো ছিল শাশুড়ির আর সেই মানুষের জেদ ও অগাধ আস্থাই আজ সে পড়শোনা করে এই গ্রামের দিদিমনি। তার আজকের এই সাফল্যর পিছনে অবদান যে ওইদুটো মানুষেরই বেশি ছিল, আরো একজন মানুষ যে ছিল হঠাৎ করে হারিয়েও গেলো হায়.....। এসব ভাবতে ভাবতেই বাসন্তী ঘুমিয়ে পড়ে।সকালে উঠে ঘর ঝাড়ু দিয়ে বাসি কাজ সেরে, চান করে পুজো দিয়ে রান্না চাপায় ।তারপর মেয়েকে ঘুম থেকে তুলতে যায় আজ সে স্কুলে যাবে প্রথম ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার ।
ফুল ও ফুল ওঠো মা আজকে যে তুমি স্কুলে যাবে প্রথম ওঠো,ওঠো সোনামা দেড়ি হয়ে যাবে নাহলে তখন স্কুলের সবাই পঁচা বলবে।
মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ছোট্ট ফুলবানু ।হাসির তোরে ফুলো গাল যেনো আরো ফুলে উঠলো আর দেখতে কি যে মিষ্টি লাগছে । তা দেখে বাসন্তি মুচকি হেসে উঠলো।
আমি তো দুততু নই মা, আমি সবার থেকে আগে ভালো করে পলা(পড়া) দিয়ে দিদিমণির কাছে গুড গাল (গার্ল) হবো দেখে নিও বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো আবার ছোট্ট ফুল
মেয়ের হাসি মুখ সকাল সকাল দেখে বাসন্তীর মন যেন আনন্দে ভরে উঠলো ,মেয়ের হাসি মুখ তাকে যেনো নতুন শক্তি দেই।মেয়েকে তৈরি করিয়ে সাথে নিজেও তৈরি হয়ে খেয়ে বাড়ির মূল ফটকে তালা লাগিয়ে স্কুলে চলে গেল। আজ থেকে এক নতুন পথ চলা যে মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে, সে নিজের জীবনে যে সুযোগগুলো পাইনি তা সে তার মেয়েকে দিতে চাই।
দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে যায় বাসন্তীর মেয়ে যে বাসন্তীর মতোই মেধা পেয়েছে সেটা স্কুলে চত্বরে থাকা প্রতিটা শিক্ষক-শিক্ষিকা বুঝে গেছে যেনো। বাসন্তী কে দেখলেই তারা বলে মেয়ে আপনার ভালোই মেধাবী ছাত্রী ও অনেক বড়ো হবে দেখিয়েন। ঠিক যেভাবে একসময় তার বাবাকেও বলতেন প্রাইমারী স্কুলের দিদিমনিরা।
ফুল রোজ ফেরার পথে মায়ের সাথে স্কুলে কি কি করে,কত বন্ধু হলো,দিদিমনি কি শেখালো সব গল্প করতে করতে ফেরে।একদিন ফেরার পথে মেয়ের চোখ মুখ লাল ফোলা দেখে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে বাসন্তী। রাস্তায় এত জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা কিছুই বললো না । রাতে গা কাপিয়ে জ্বর এলো ফুলের। সারারাত ফুল বলে গেছে "আমি আ আমার মায়ের মেয়ে, আ আমাকে কুলিয়ে আনিনি " শুনে বাসন্তী হতভম্ব হয়ে যায় বুঝতে পারেনা মেয়ে কেনো এমন বলছে চিন্তায় ঘুমাতে পারলো না। সকালে ফুল ঘুম থেকে উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে বলে ওঠে মা আমি তোমাল মেয়ে । বাসন্তী মুচিকি হেসে বলে হ্যাঁ সোনা তুমিই তো আমার মেয়ে। কিন্তু স্কুলের নাল্লার(রান্নার) আন্তি কেনো বললো আমি তোমাল মেয়ে না ছলছল চোখে গলা জড়িয়ে থেকে ফুল জিজ্ঞেস করলো । আশ্চর্য হয়ে যায় বাসন্তী যে মেয়েকে সে জন্ম দিল সে তার মেয়ে না e কেমন কথা। সে মেয়ের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছিল স্কুলে? ফুল বলে স্কুলের মাঠে খেলতে খেলতে রান্নার অ্যান্টি কাঠ নিয়ে যেতে দেখে সেও ছুটে যায় সাহায্য করতে । তাকে সাহায্য করতে দেখে রান্নার মেয়েটি খুশি হয়ে তাকে দুটো বাতাসা দেই খেতে। তারপর তার নাম জিজ্ঞেস করে ওর নাম শুনে বলে " একি লো খুকি তোমার নাম মোল্লাদের নাগাল কেন?? আমি হুনেছি তোমার মা হাই ইস্কুলের দিদিমনি সেও তো হিন্দু নামটা কি জানি যেনো , ও হ্যাঁ মনে পরলো বাচন্তী ,তোমারে কি পালছে তোমার মা?তুমি কি মোল্লা হেগা মেয়ে? " উত্তরে সে তখন বলেছিল " আমার মায়ের নাম বাসন্তী, বাচন্তী না ,আল আমি আমাল মায়েল মেয়ে বুঝছো? "
সে তুমি যাই বলো খুকি তোমারে তোমার মা অন্য কারোর থেকে নিয়েছে ,নাহলে কোনোদিনও হুনিনি,হিন্দু বাড়ির মেয়ের নাম মোল্লাদের নাগাল হতি ।
কেনো আমাল( আমার) নাম ইকটু অন্য বলে কি আমি আমাল মায়ের হতে পালিনা ? তুমি কিট্টু(কিছু) দানো (জানো) না । মিথ্যে বলো খালি খালি আমি সব জানি ছলছল চোখে বলে ওঠে ফুল।
মিথ্যে কেনো বলবো তুমি দেখো আমার নাম লক্ষী আমার মেয়ের নাম দুগ্গা কিন্তু তোমার মার সাথে তোমার নামের কোনো মিল নেই । বলে আরো অনেক উল্টোপাল্টা বোঝাই ছোট্ট ফুলকে ।যা তার মনে খুব বাজে ভাবে প্রভাব ফেলে। ছোট্ট ফুল খুব কাঁদে যার কারণে জ্বর চলে আসে। এসব শুনে বাসন্তী মেয়েকে বুকে চেপে বলে তুমি আমার মেয়ে। দেখো না তোমার আমার চেহারায় কত মিল। না আমি আমাল(আমার) বাবাল মতো দেখতে ।আমি ছবিতে দেখেছি মুখ ভার করে বললো ফুল। ওরে দুষ্টু চুপিচুপি বাবার সঙ্গে নিজের মিল দেখেও মায়ের সাথে দুষ্টু দুষ্টু করা হচ্ছে বলেই মেয়েকে কাতুকুতু দিতে লাগলো বাসন্তী ।ক্ষণিকের মধ্যে ঘরজুড়ে মা মেয়ের হাসির আওয়াজে ঘর ভরে উঠলো।
হাঁসি থামিয়ে ফুল বললো আমার নাম কেনো এমন লেখেছো( রেখেছো) মা?
তুমি যে ফুলের মত দেখতে ,ফুলের মত স্নিগ্ধ আর নরম তাই । আরও একটা কারণ আছে তোমার এই নাম রাখার কারণ হলো আমার সই................
---------------------------------------------------------------------
একটা ছোট্ট পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে হাতে ফুল নিয়ে
খুব উচ্ছাস নিয়ে ছুটে ছুটে এসে তার মাকে জিজ্ঞেস করে মা মা ও মা কলিকেতে কোথায় মা ?? কলিকেতে কোথায় ??
চলবে........
আসসালামু আলাইকুম সবাইকে কেমন আছেন সবাই?আশা করছি সবাই ভালো আছেন। একটা ছোট গল্প নিয়ে এসেছি এটা দুই পর্বের গল্প আশা করি সবার ভালোই লাগবে । ফুলবানু পুচকির নামটি কার নামে রাখা? কেনো রাখা ? কে সেই সই বাসন্তীর?? জানতে হলে পরবর্তী পার্ট এর জন্য অপেক্ষা করুন ।পড়ার শেষে লাইক ও আপনার কেমন লাগলো জানাতে পারেন ।আর আমার গল্পটি যদি ভালো লাগে তাহলে আমার আইডিটি ফলো দিয়ে পাশে থাকুন
📍surjomuki
ধন্যবাদ 🌼🍁
#ফুলবানু
#পর্ব - ১
#লেখনীতে_সারিকা_মন্ডল_প্রিয়া