আশা ।। পর্ব ০১ ।। কলমে - আইয়ুব খাঁন
জেলের বিশাল উঁচু পাঁচিল দেখে আপনার বাইরে থেকে মনে হতে পারে ওর ভিতরে কেবল অপরাধীরাই বন্দি আছে। কিন্তু আপনি জেলের ভেতরে ঢুকে খবর নিয়ে দেখুন, অনেকেই আছেন বিনা অপরাধে! কেবল তথ্য-প্রমাণের অভাবে তাদের এই শক্ত কঠিন নির্বোধ উঁচু দেওয়াল গুলো বন্দি করে রেখেছে।
এই জেলের একদিকে আছে ছেলেদের সেল, অন্যদিকে আছে মেয়েদের সেল। মাঝখানে লোহার মোটামোটা রড দিয়ে অনেক উঁচু পর্যন্ত গিরিলের পার্টিশন। বিকেল হলেই দুই সেলের আসামীদের বের করা হয় জেলের বিশাল এই গ্রাউন্ডে। আসামীদের কেউ সময় কাটায় হাঁসি ঠাট্টা গল্প করে, আবার কেউ কেউ খেলে ফুটবল, ভলিবল ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ বিকেলে সমস্ত আসামীদের কোলাহলের মধ্যে জেলের লোহার গ্রিলের পার্টিশনের একদিকে হীরালাল অন্যদিকে মন্দিরা দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরা তার স্বামী হত্যার দায় জেল খাটছে। তার একমাত্র মেয়ে 'আশা' যাকে সে খুব ভালোবাসে। তাকে সে মাত্র নয় বছর বয়সে জেলের বাইরে এই নিষ্ঠুর সমাজের বুকে ফেলে রেখ সে এখানকার বাসিন্দা হয়েছে। তাই সে সবসময়ই তার মেয়ে "আশার" ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। কারণ তার আর কেউ নাই।
তার মেয়ে আশাকে নিয়ে গেছে তার একমাত্র ননদ কাদম্বরী। যে কিনা থাকে নিষিদ্ধ পল্লী সোনাগাছিতে। যার কারনেই মন্দিরা সব সময় তার মেয়ে আশাকে নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে। তবে হীরালালকে দেখে মন্দিরার মনে আশা জেগেছে, এই নির্মম পৃথিবীতে আরও দুদিন বেঁচে থাকার।
দুজনের মধ্যে এই কয়েকদিন আগে পরিচয় হয়েছে। তাতেই তাদের মধ্যে বেশ সখ্যতাও তৈরি হয়েছে। আজ মন্দিরা জানতে চাইছে হীরালালের থেকে, "স্যার, আপনি কোন অপরাধে জেল খাটছেন?"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হীরালাল বলল, "সে অনেক ঘটনা। আপনাকে তাহলে শুরু থেকেই বলতে হয়।"
মন্দিরা উৎসুক হয়ে হীরালালের থেকে তা শুনতে চাইল। আর হীরালাল বলতে শুরু করল, "বিকাল থেকে সারা বাড়ি আর ডাইনিং রুমটা খুব যত্ন করে সাজিয়েছে সবাই মিলে। বাড়িতে জন্মদিনের পার্টির আনন্দে সবাই যখন মেতে উঠেছে। তখনও কিন্তু আমি বাড়ি ফিরতে পারিনি। ভিষন কাজের চাপ ছিল। সেদিন ছিল আমার ছেলে শৈবালের জন্মদিন। শৈবাল সেদিন সাত বছরে পা দিয়েছিল। আত্মীয়-স্বজন থেকে ছোট্ট শৈবালের বন্ধু বান্ধবী সবাই এসেছিল বাড়িতে। আর সেই আনন্দের মাঝে অধিক রাত্রি পর্যন্ত কিন্তু জন্মদিনের কেক কাটা হয়নি। কারন যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরছি, তত সময় পর্যন্ত কিছুতেই জন্মদিনের কেক কাটতে রাজি হচ্ছিল না আমার ছোট্ট শৈবাল।"
*************************
হীরালাল, হীরালাল সিংহ, বয়স এই বছর চল্লিশেক হবে। পেশায়, সার্কেল ইন্সপেক্টর মহিষাদল। কয়েকটা থানা তার আন্ডারে চলে। সামনে দেশের সাধারণ নির্বাচন, তাই তার উপরেই প্রচণ্ড চাপ। তাই ছেলের জন্মদিনেও যথাসময়ে বাড়ি ফেরা তার কাছে দুষ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের বাড়ি নদীয়ার নবদ্বীপে। চাকরি সূত্রে মহিষাদলের সি. আই অফিসার। তাই তাকে মহিষাদলেরই সরকারি বাংলোই থাকতে হয়েছে। সরকারি বাংলোতে নিজের কলিগদের ছেলেমেয়ে থেকে বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এমনকি নিজের বাবা-মা ভাই বোন সবাই আজ এসেছে। কারণ হীরালালের একমাত্র ছেলে ছোট্ট শৈবাল আজ সাত বছরে পা দিল।
তখন ঘড়িতে রাত্রি দশটা। উপস্থিত সবার ধৈর্য প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে হীরালালের ফোনটাও লাগছে না। তাই শৈবালের দাদু বললেন, "দাদুভাই তোমার বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। অনেক বড়ো কাজ করে, তাই ওর আসতে অনেক দেরি হবে। এসো আমরা সবাই মিলে সেলিব্রেট করে কেক কেটে ফেলি।"
শৈবাল চিৎকার করে বলল, "না না দাদুভাই, তা হবে না। পাপা এলে তবেই কেক কাটা হবে।"
সবাই মিলে ছোট্ট শৈবালকে কেক কাটার জন্য বললেও, শৈবাল কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। কারণ তার বাবার অনুপস্থিতিতে সে কিছুতেই জন্মদিনের কেক কাটবে না। এদিকে মালতি বারবার ফোন করেও হীরালালকে কিছুতেই ফোনে পাচ্ছিল না।
মালতি, মালতি চক্রবর্তী সিং, বয়স ওই বছর ৩৫ হবে। সে হলো শৈবালের মা অর্থাৎ হীরালালের স্ত্রী। তারা গ্রাজুয়েট হয়েছে একই কলেজ থেকে। এক কলেজেই পড়াশোনার কারণেই তাদের আলাপ। তারপর ভবিষ্যতের জন্য যে যার লাইন আলাদা করে নিয়েছিল। তবে কলেজে পড়ার সময় তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে গিয়েছিল। শেষমেষ তাদের এই প্রেম বিবাহ বন্ধনে পরিণত হয়েছে।
এদিকে অস্থির হয়ে সবাই ছোট্ট শৈবালকে নানান কথা বলছিল। মানে বাবার জন্য অপেক্ষা না করে কেকটা কেটে নেওয়ার কথা বলছিল। কিন্তু তাদের কারোর কথা কিছুতেই ছোট্ট শৈবাল কর্ণপাত করেনি। সে তার বাবার অপেক্ষায় ছিল। তাই তার প্রতিক্ষায় কর্নিং বেলের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে অধীর আগ্রহে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল। সামনে সাজানো টেবিল, তার উপরে জন্মদিনের সুন্দর একটি কেক। শৈবাল কেকটিকে সামনে রেখে চোখের পলক না ফেলেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল দরজার দিকে।
একসময় একে একে করে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবী সবাই চলে যেতে লাগলো। তাতেও ছোট্ট শৈবালের ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল, কেউ কেউ ঘুমে ঢলে পড়েছিল, আবার কেউ বিছানায় শুয়ে পড়েছিল, তখনও ছোট্ট শৈবাল তার মায়ের সাথে সাজানো টেবিলে কেকটিকে সামনে রেখে অধির আগ্রহে বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল।
অবশেষে বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। উৎফুল্ল হয়ে শৈবাল চিৎকার করে বলতে থাকলো, "পাপা এসেছে, পাপা এসেছে"
গাড়ির শব্দ শুনেই পাপা বলে শৈবাল ছুটে গেল দরজার দিকে। ছোট্ট শৈবাল খুব কষ্ট করে দরজার শেকল খুলল। হীরালাল তখন তার বাতি লাগানো গাড়ি থেকে উপহার নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে এলো। শৈবাল তখন তার পাপার দিকে চিৎকার করে ছুটতে লাগল। তখন হীরালাল তীরের গতিতে ছোট্ট শৈবালের দিকে একটা উপহার নিয়ে ছুটে এলো। তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল।
ছোট্ট শৈবাল বলল , "পাপা কোথায় ছিলে তুমি?"
হীরালাল আদর করতে করতে বলল, "বাবা, আমি অনেক গুলো বড়ো কাজের মধ্যে ব্যস্ত ছিলাম। এখন আমি এই এসেগেছি। আর কোন চিন্তা নাই, এখন আমি তোমাকে নিয়ে মজা করবো, আনন্দ করবো।"
বাবার আনা উপহার রিমোট দেওয়া গাড়ি দেখে ছোট্ট শৈবাল আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে বলল, "পাপা, পাপা এটা কি রিমোট দেওয়া গাড়ি? এটা কি আমার জন্য এনেছো?"
হীরালাল আদর করে বলল, "হা ওটা তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য পাপা। "
শৈবালের আনন্দ তখন ধরে রাখা দায়। সে তখন হীরালালকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিতে দিতে বলল, "থ্যাংক ইউ পাপা। আমার সোনা পাপা।"
তত সময়ে মালতি চলে এসেছে। মালতি বলল, "তুমি কি ভুলেই গিয়েছিলে তোমার ছেলের জন্মদিনের কথা। তুমি তো জানো তোমার ছেলে এতো জেদি কারোর কোন কথাই শুনবে না। কিছুতেই কারোর কথাতে কেক কাটছিল না। তুমি না এলে আমাদের শৈবাল যে কারোর কোন কথা শুনে না, কেক কাটবে না, এটা তুমি কি জান না? কেন এত দেরি করলে? অনেক রাত্রি হয়ে গেল। প্রায় এগারোটা বাজে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা যে যার ঘুমিয়ে পড়েছে।"
কিন্তু না! রিমোট দেওয়া গাড়ি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে শৈবাল যেভাবে চিৎকার শুরু করল, শৈবালের আনন্দের চিৎকারে আবার সকলে একে একে ডাইনিং রুমে জড়ো হলো। বাড়িতে ঢুকতেই হীরালালের বাবা মানিক বাবু বললেন, "বাবা তুই তো ভালো করে জানিস, তোর ছেলেটা ভীষণ জেদি। তোকে না পেলে সে কিছুতেই কেক কাটবে না। তোকে এত ভালবাসে তোর কথা ছাড়া কারোর কথা শোনে না। একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারতিস, অনেক রাত্রি হয়ে গেল। সবাই কি এত রাত্রি পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে?"
হীরালাল বলল, "বাবা তুমি তো জানোই, এখন ইলেকশনের সময় এভাবে টাইম বের করাটাও আমার কাছে ভীষণ মুশকিল।"
হীরালাল যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন কিন্তু তার তিনটে মোবাইল ফোনে মুহুর মুহুর কল ঢুকছিল। তাতে বিরক্ত হয়ে হীরালালের মা জানোকি দেবী বললেন, "ঠিক আছে, এইটুকু সময় বাড়িতে ফিরে এসেছিস ফোনের কল রিসিভ না করলেই কি হয় না। কিছুটা সময় অন্তত বাড়ির জন্য ছেলের জন্য দে।"
হীরালাল তখন বলল, "মা তুমি তো জানো আমাদের ডিউটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ডিউটি অবস্থাতে কত সিরিয়াস ভাবে থাকতে হয়, কোন কিছুকে অবজ্ঞা করা যায় না মা। ঠিক আছে তোমরা তো সবাই আছো। আমার খুব ভালো লেগেছে এত রাত্রি পর্যন্ত সবাই জেগে আছো। আমার ছোট ছোট খুদেরাও দেখছি সবাই জেগে আছে?"
খুদেরা সবাই একত্রে বলল, "হা আঙ্কেল।"
হীরালাল বলল, "আমার খুব ভালো লেগেছে তোমরা সবাই এখনো পর্যন্ত জেগে আছো। আমরা সবাই একসাথে কেক কাটব আনন্দ করব।"
জন্মদিনের জন্য সুন্দর করে বাড়ির চারিদিকে সাজানো হয়েছে। হীরালালের বাবা মা থেকে সবাই আজ বাড়িতে এসেছে। যদিও সবাই বুঝে হীরালালের কতটা দায়িত্ব এই মুহূর্তে। তাই বিলম্ব না করে কেক কাটার পর্ব শুরু হলো। সবাই হ্যাপি বার্থডে টু ইউ শৈবাল বলে সমস্বরে গান গাইলো। তারই মাঝে হীরালালের কাছে একটি ফোন বারবার বেজে উঠল।
হীরালাল বাধ্য হয়ে ফোনটিকে রিসিভ করল, ফোনের অপর প্রান্তের কথা হীরালাল অবাক হয়ে শুনল। তারপর হীরালাল ব্যস্ততা দেখিয়ে শৈবালের মাথায় চুমু খেয়ে মালতিকে বলল, "আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। আর্জেন্ট আছে, তুমি ব্যাপারটা সামলাও। সবাই যেন ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া করে। একথা বলেই সটান করে হীরালাল বাড়ি থেকে আবার বেরিয়ে গেল। সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
*************************
🙏পর্বটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
👉পরের পর্ব গুলো পেতে হলে আমাকে অনুসরণ করুন। তাহলে পরের পর্ব আপলোড করার সাথে সাথে আপনার কাছে নটিফিকেন চলে যাবে।
👉ভালো লাগলে লাইক /কমেন্ট ও শেয়ার করুন।
👉কয়েন প্রদান করে আমাকে উৎসাহিত করুন।
👉ধারাবাহিক ভাবে চলবে।