Chokher Bali - 30 in Bengali Fiction Stories by Rabindranath Tagore books and stories PDF | চোখের বালি - 30

Featured Books
  • One Step Away

    One Step AwayHe was the kind of boy everyone noticed—not for...

  • Nia - 1

    Amsterdam.The cobbled streets, the smell of roasted nuts, an...

  • Autumn Love

    She willed herself to not to check her phone to see if he ha...

  • Tehran ufo incident

    September 18, 1976 – Tehran, IranMajor Parviz Jafari had jus...

  • Disturbed - 36

    Disturbed (An investigative, romantic and psychological thri...

Categories
Share

চোখের বালি - 30

30

৩০

আশা একদিন অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করিল, "আচ্ছা মাসিমা, মেসোমশায়কে তোমার মনে পড়ে?"

অন্নপূর্ণা কহিলেন, "আমি এগারো বৎসর বয়সে বিধবা হইয়াছি, স্বামীর মূর্তি ছায়ার মতো মনে হয়।"

আশা জিজ্ঞাসা করিল, "মাসি, তবে তুমি কাহার কথা ভাব।"

অন্নপূর্ণা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, "আমার স্বামী এখন যাঁহার মধ্যে আছেন, সেই ভগবানের কথা ভাবি।"

আশা কহিল, "তাহাতে তুমি সুখ পাও?"

অন্নপূর্ণা সস্নেহে আশার মাথায় হাত বুলাইয়া কহিলেন, "আমার সে মনের কথা তুই কি বুঝবি বাছা। সে আমার মন জানে, আর যাঁর কথা ভাবি তিনিই জানেন।"

আশা মনে মনে ভাবিতে লাগিল, "আমি যাঁর কথা রাত্রিদিন ভাবি, তিনি কি আমার মনের কথা জানেন না। আমি ভালো করিয়া চিঠি লিখিতে পারি না বলিয়া তিনি কেন আমাকে চিঠি লেখা ছাড়িয়া দিয়াছেন।'

আশা কয়দিন মহেন্দ্রের চিঠি পায় নাই। নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে সে ভাবিল, "চোখের বালি যদি হাতের কাছে থাকিত, সে আমার মনের কথা ঠিকমতো করিয়া লিখিয়া দিতে পারিত।'

কুলিখিত তুচ্ছপত্র স্বামীর কাছে আদর পাইবে না মনে করিয়া চিঠি লিখিতে কিছুতে আশার হাত সরিত না। যতই যত্ন করিয়া লিখিতে চাহিত, ততই তাহার অক্ষর খারাপ হইয়া যাইত। মনের কথা যতই ভালো করিয়া গুছাইয়া লইবার চেষ্টা করিত ততই তাহার পদ কোনোমতেই সম্পূর্ণ হইত না। যদি একটিমাত্র "শ্রীচরণেষু" লিখিয়া নাম সহি করিলেই মহেন্দ্র অন্তর্যামী দেবতার মতো সকল কথা বুঝিতে পারিত, তাহা হইলেই আশার চিঠিলেখা সার্থক হইত। বিধাতা এতখানি ভালোবাসা দিয়াছিলেন, একটুখানি ভাষা দেন নাই কেন।

মন্দিরে সন্ধ্যারতির পরে গৃহে ফিরিয়া আসিয়া আশা অন্নপূর্ণার পায়ের কাছে বসিয়া আস্তে আস্তে তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ নিঃশব্দের পর বলিল, "মাসি, তুমি যে বল, স্বামীকে দেবতার মতো করিয়া সেবা করা স্ত্রীর ধর্ম, কিন্তু যে স্ত্রী মূর্খ, যাহার বুদ্ধি নাই, কেমন করিয়া স্বামীর সেবা করিতে হয় যে জানে না, সে কী করিবে।"

অন্নপূর্ণা কিছুক্ষণ আশার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন--একটি চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, "বাছা, আমিও তো মূর্খ, তবুও তো ভগবানের সেবা করিয়া থাকি।"

আশা কহিল, "তিনি যে তোমার মন জানেন, তাই খুশি হন। কিন্তু মনে করো, স্বামী যদি মূর্খের সেবায় খুশি না হন?"

অন্নপূর্ণা কহিলেন, "সকলকে খুশি করিবার শক্তি সকলের থাকে না, বাছা। স্ত্রী যদি আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তিযত্নের সঙ্গে স্বামীর সেবা ও সংসারের কাজ করে, তবে স্বামী তাহা তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিলেও স্বয়ং জগদীশ্বর তাহা কুড়াইয়া লন।"

আশা নিরুত্তরে চুপ করিয়া রহিল। মাসির এই কথা হইতে সান্ত্বনা গ্রহণের অনেক চেষ্টা করিল, কিন্তু স্বামী যাহাকে তুচ্ছ করিয়া ফেলিয়া দিবেন, জগদীশ্বরও যে তাহাকে সার্থকতা দিতে পারিবেন, এ কথা কিছুতেই তাহার মনে হইল না। সে নতমুখে বসিয়া তাহার মাসির পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।

অন্নপূর্ণা তখন আশার হাত ধরিয়া তাহাকে আরো কাছে টানিয়া লইবেন। তাহার মস্তক চুম্বন করিলেন; রুদ্ধকণ্ঠকে দৃঢ়চেষ্টায় বাধামুক্ত করিয়া কহিলেন, "চুনি, দুঃখে কষ্টে যে শিক্ষালাভ হয় শুধু কানে শুনিয়া তাহা পাইবি না। তোর এই মাসিও একদিন তোর বয়সে তোরই মতো সংসারের সঙ্গে মস্ত করিয়া দেনাপাওনার সম্পর্ক পাতিয়া বসিয়াছিল। তখন আমিও তোরই মতো মনে করিতাম, যাহার সেবা করিব তাহার সন্তোষ না জন্মিবে কেন। যাহার পূজা করিব তাহার প্রসাদ না পাইব কেন। যাহার ভালোর চেষ্টা করিব, সে আমার চেষ্টাকে ভালো বলিয়া না বুঝিবে কেন। পদে পদে দেখিলাম, সেরূপ হয় না। অবশেষে একদিন অসহ্য হইয়া মনে হইল, পৃথিবীতে আমার সমস্তই ব্যর্থ হইয়াছে--সেইদিনই সংসার ত্যাগ করিয়া আসিলাম। আজ দেখিতেছি, আমার কিছুই নিষ্ফল হয় নাই। ওরে বাছা, যাঁর সঙ্গে আসল দেনাপাওনার সম্পর্ক, যিনি এই সংসার-হাটের মূল মহাজন, তিনিই আমার সমস্তই লইতেছিলেন, হৃদয়ে বসিয়া আজ সে কথা স্বীকার করিয়াছেন। তখন যদি জানিতাম! যদি তাঁর কর্ম বলিয়া সংসারের কর্ম করিতাম, তাঁকে দিলাম বলিয়াই সংসারকে হৃদয় দিতাম,তা হইলে কে আমাকে দুঃখ দিতে পারিত।"

আশা বিছানায় শুইয়া শুইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত অনেক কথা ভাবিল, তবু ভালো করিয়া কিছুই বুঝিতে পারিল না। কিন্তু পুণ্যবতী মাসির প্রতি তাহার অসীম ভক্তি ছিল, সেই মাসির কথা সম্পূর্ণ না বুঝিলেও একপ্রকার শিরোধার্য করিয়া লইল। মাসি সকল সংসারের উপরে যাঁহাকে হৃদয়ে স্থান দিয়াছেন, তাঁহার উদ্দেশে অন্ধকারে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া গড় করিয়া প্রণাম করিল। বলিল, "আমি বালিকা, তোমাকে জানি না, আমি কেবল আমার স্বামীকে জানি, সেজন্য অপরাধ লইয়ো না। আমার স্বামীকে আমি যে পূজা দিই, ভগবান, তুমি তাঁহাকে তাহা গ্রহণ করিতে বলিয়ো তিনি যদি তাহা পায়ে ঠেলিয়া দেন, তবে আর বাঁচিব না। আমি আমার মাসিমার মতো পুণ্যবতী নই, তোমাকে আশ্রয় করিয়া আমি রক্ষা পাইব না।" এই বলিয়া আশা বার বার বিছানার উপর গড় করিয়া প্রণাম করিল।

আশার জেঠামশায়ের ফিরিবার সময় হইল। বিদায়ের পূর্বসন্ধ্যায় অন্নপূর্ণা আশাকে আপনার কোলে বসাইয়া কহিলেন, "চুনি, মা আমার, সংসারের শোক-দুঃখ-অমঙ্গল হইতে তোকে সর্বদা রক্ষা করিবার শক্তি আমার নাই। আমার এই উপবেশ, যেখান থেকে যত কষ্টই পাস, তোর বিশ্বাস তোর ভক্তি স্থির রাখিস, তোর ধর্ম যেন অটল থাকে।"

আশা তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া কহিল, "আশীর্বাদ করো মাসিমা, তাই হইবে।"